দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামের একটা স্ট্যান্ডের নাম রাখা হয়েছে বিষেণ সিং বেদির নামে। ইউটিউবে তাঁর বাঁহাতি স্পিন বোলিংয়ের কিছু সাদাকালো ফুটেজ দেখে আসুন। মনে হবে স্বপ্ন দেখছেন। ছোট ছোট পায়ের সুন্দর রানআপ, রিপিটেবল অ্যাকশন আর অবিশ্বাস্য সুন্দর ফ্লাইট—সবটাই ক্রিকেটপিপাসুদের স্বপ্নের মতো। ব্যাটসম্যানদের জন্য অবশ্য দুঃস্বপ্ন। কখনো সেই সুন্দর ফ্লাইটে, না হয় গতির বৈচিত্র্যে অথবা বাঁকে পরাস্ত হয়েছেন ব্যাটসম্যানরা।
গতকাল রাতে সে মাঠেই রিয়ান পরাগ ২ ওভারের স্পিন বোলিং করলেন। ১২টি বলের মধ্যে একটিও বাঁক নেয়নি। কিন্তু বল করেছেন দু-তিন রকমের রিলিজ পয়েন্ট থেকে। একবার তো নন স্ট্রাইক প্রান্তের উইকেটের সমান ছিল পরাগের রিলিজ পয়েন্ট! একটু হেঁটে এসে ২ ওভার বাঁহাতি স্পিন করেছেন অভিষেক শর্মাও। বরুণ চক্রবর্তী তাঁর ক্যারম বল, গুগলি, অফ স্পিন করেছেন। ওয়াশিংটন সুন্দরও গতিময় স্পিনার। সেই মায়াবী ফ্লাইট খুঁজে পাবেন না তাঁর বোলিংয়েও।
ঝলমলে অক্ষরে বিষেণ সিং বেদির নাম খোদাই করা গ্যালারির সামনেই বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ক্রিকেটটা বদলে যাওয়ার বহু উদাহরণ খুঁজে পাবেন। স্পিনাররা এখন বেদির মতো ঘণ্টায় ৬০-৭০ কিলোমিটারে বোলিং করেন না, স্পিনারদের এখন হরহামেশা ৯০ কিলোমিটারে বল করতে দেখতে পাবেন। ওই গতিতেই কিছুটা বাঁক, কিছুটা অ্যাঙ্গেল, কিছুটা বৈচিত্র্য যোগ করে ব্যাটের মাঝখান থেকে দূরে থাকার চেষ্টার নামই আধুনিক টি-টোয়েন্টি বোলিং।
বাংলাদেশ দলে এ ধরনের স্পিন বোলিংটা করে থাকেন শেখ মেহেদী হাসান। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পাওয়ার প্লেতে বোলিং করা স্পিনারদের মধ্যে মেহেদীর নামটা ওপরের দিকেই থাকবে। ডানহাতি কিংবা বাঁহাতি—ব্যাটসম্যান যেমনই হোক, এমন বৈচিত্র্যময় অফ স্পিন বোলিংটা করে থাকেন তিনি। কিন্তু মেহেদী হাসান মিরাজ এক বছরের বেশি সময় পর টি-টোয়েন্টি দলে ফেরায় মেহেদীকে একাদশে জায়গা ছাড়তে হচ্ছে।
দুজনেরই প্রোফাইলে ‘অফ স্পিনার’ লেখা খুঁজে পাবেন। কিন্তু শেখ মেহেদীর সঙ্গে মিরাজের টি-টোয়েন্টি বোলিংয়ে বিরাট পার্থক্য। মেহেদী বল হাতে যা করেন, তাঁকে অফ স্পিন বলার চেয়ে শুধু ‘বোলিং’ বলা শ্রেয়। কারণ ব্যাটসম্যানের পায়ের কাজ দেখে শেষ মুহূর্তে একটা ইয়র্কারও মেরে দিতে পারেন মেহেদী।
মিরাজের সে দক্ষতা নেই তা নয়। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে উন্নতি করা ক্রিকেটার তো মিরাজই। কিন্তু মিরাজের সাফল্য এসেছে মূলত টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে। ছোট্ট সংস্করণের ক্রিকেটে তিনি কখনোই দলে জায়গা পাকা করতে পারেননি। শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে খেললে হয়তো টি-টোয়েন্টির মারদাঙ্গা ক্রিকেটের মানানসই বোলিংয়ের দক্ষতাটাও মিরাজ এত দিনে রপ্ত করে ফেলতেন।
কিন্তু টি-টোয়েন্টি দলে একজন অফ স্পিনিং অলরাউন্ডারের অভাবটা মেহেদীই পূরণ করে এসেছেন। তাই মিরাজের দরকার হয়নি। মেহেদী এখনো আছেন। কিন্তু হুট করে ভারতের মতো দলের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে ডাক পাওয়ায় মিরাজের টি-টোয়েন্টি বোলিংয়ের দুর্বলতাগুলো বাজেভাবে সামনে আসছে।
শুধু কি বোলিং? ব্যাটিং দক্ষতায় শেখ মেহেদীর চেয়ে মিরাজ এগিয়ে থাকলেও সেটা টি-টোয়েন্টিসুলভ নয়। টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটের চূড়ান্ত চাপের মুহূর্তে মিরাজের ব্যাট বহুবার বাংলাদেশকে বিপদমুক্ত করেছে, নিয়ে গেছে দাপুটে অবস্থানে। হার না মানার প্রচণ্ড শক্তিশালী মানসিকতার সঙ্গে দারুণ ডিফেন্সিভ টেকনিক মিরাজের টেস্ট, ওয়ানডের সাফল্যের ভিত। প্রতিপক্ষ দলের সেরা বোলারের সেরা বলটাকে ঠেকিয়ে দেওয়ায় দারুণ দক্ষ তিনি। কিন্তু ২০ ওভারের খেলায় সেই ভালো বলেই ছক্কা মারতে হয়। মিরাজের ব্যাটিং দক্ষতা সেখানে ‘সীমিত’।
অথচ ভারত সফরের টি-টোয়েন্টি সফরের দলে মিরাজকে সুযোগ দেওয়ার ব্যাখ্যায় তাঁকে সাকিব আল হাসানের বিকল্প হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। অধিনায়ক অবশ্য এ কথাও বলেছেন, এখনই সাকিব না থাকায় সৃষ্টি হওয়া বিশাল শূন্যতা পূরণ করবেন মিরাজ, তা ভাবা ঠিক হবে না। মিরাজকে ৮ থেকে ১০টি ম্যাচ দিতে হবে।
কিন্তু মিরাজ কি আসলেই সাকিবের বিকল্প হিসেবে খেলছেন? ব্যাটিংয়ের ধরন বলে তাঁকে খেলানো হচ্ছে মাহমুদউল্লাহর বিকল্প হিসেবে। চাপের মুখে জুটি গড়ে দলের মানরক্ষার কাজটা মাহমুদউল্লাহ করে এসেছেন বছরের পর বছর। হায়দরাবাদে ভারত সিরিজের শেষ ম্যাচ খেলে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দেওয়া এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ছিলেন বাংলাদেশের ‘সেফটি নেট’।
দলের জয়–পরাজয় পরে, টপ অর্ডারের নিয়মিত ধসের পর বাংলাদেশের রানটাকে একটু ভদ্রস্থ জায়গায় নেওয়ার কাজটা মাহমুদউল্লাহ করে এসেছেন সফলভাবে। গতকাল যেমন তিনি ৩৯ বলে ৪১ রান করেছেন, বাংলাদেশের রান গেছে ১৩০-এর ঘরে। কিন্তু দল হেরেছে ৮৬ রানে। তাঁর ইনিংসটি বাদ দিলে বাংলাদেশের এক শ রান করতেও কষ্ট হতো।