ভিন দেশে খেলতে গেলে কন্ডিশনের চ্যালেঞ্জ থাকে, যার মধ্যে প্রথমেই আসবে উইকেট। চেন্নাইয়ে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টেও চ্যালেঞ্জ থাকছে। যে চ্যালেঞ্জের রং লাল না কালো হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন ছিল। কন্ডিশনের বাইরেও চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিচ্ছে সিরিজের আগে ভারতের সংবাদমাধ্যমের বাংলাদেশের সঙ্গে মাইন্ড গেম খেলার চেষ্টা।
উইকেট যে লাল মাটিরই হচ্ছে, সেটি অবশ্য আগেই জানা গিয়েছিল। যেটি দেখা হয়ে গেল আজ মাঠে গিয়ে। তখনো সূর্য উত্তাপ ছড়ানো শুরু করেনি। এম এ চিদাম্বরম স্টেডিয়ামের বিশাল গ্যালারি রাস্তার অনেকটা জুড়েই ছায়া দিয়ে রেখেছে। স্কুলবাসগুলো এসে ছায়ায় থামছিল। পাশেই স্টেডিয়ামের ১২ নম্বর গেট। ছাত্রছাত্রীর একটা দল হুড়মুড়িয়ে সে বাসে চড়ে বসল। কিছুক্ষণের জন্য এলাকাটা সরগরম থাকল। বাস চলে যাওয়ার পর আবার নীরবতা। আরেকটু দূরে হেঁটে গেলেই স্টেডিয়ামের মিডিয়া গেট। সেদিক দিয়ে মাঠে ঢুকতেই সবুজে মোড়ানো চিপক স্টেডিয়ামের মাঝে লাল মাটির ২২ গজে চোখ পড়ল। খুব যত্ন করে যার ওপর রোল করছিল মাঠকর্মীদের একটা দল।
বুধবার সকালে মাঠে এসে ঋষভ পন্ত, সরফরাজ খান ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে উইকেট দেখে গেলেন। দুপুরের দিকে অনুশীলনে এসে দেখলেন নাজমুল-মুমিনুলরা। তখন অবশ্য সূর্যের গনগনে আঁচে চামড়া পোড়ার মতো অবস্থা। প্রেসবক্স থেকে বের হয়ে মনে পড়ল চেন্নাই ক্রিকেট নিয়ে পুরোনো কথাটা—গরমের উত্তাপ থেকে বাঁচতে পারলেও উইকেট থেকে বাঁচতে পারবে না। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে টেস্ট সিরিজ খেলে আসায় চেন্নাইয়ের গরম বাংলাদেশের জন্য খুব একটা দুশ্চিন্তা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কাল শুরু চেন্নাই টেস্টের লাল মাটির উইকেট বাংলাদেশকে নিশ্চিতভাবেই ভাবাবে।
কারণটা অনুমেয়। ভারতে বাংলাদেশ টেস্ট ম্যাচ খেলেছেই মাত্র তিনটি, সর্বশেষটি ২০১৯ সালে। এ ধরনের কন্ডিশনে এর আগে দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ দলের খুব বেশি খেলোয়াড়ের নেই। জাকির হাসান, জাকের আলী, নাঈম হাসানের অবশ্য ‘এ’ দলের সফরে এমন কন্ডিশনে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। সে অভিজ্ঞতা বলছে, লাল মাটির উইকেটে টার্ন হয় জোরে, ব্যাটসম্যান মানিয়ে নেওয়ার সময় পান খুব কম। তবে টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামার আগে উইকেট সম্পর্কে এটুকু তথ্য যথেষ্ট নয়। চেন্নাই আসার আগে তাই গত বছর আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে ৯ ম্যাচ খেলা মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে আলাদা করেই বসেছিলেন নাজমুলরা।
লাল মাটির উইকেটে টার্ন হয় জোরে, ব্যাটসম্যান মানিয়ে নেওয়ার সময় পান খুব কম। তবে টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামার আগে উইকেট সম্পর্কে এটুকু তথ্য যথেষ্ট নয়।
কিন্তু এসব তো শুধুই ‘হোমওয়ার্ক’। আসল পরীক্ষাটা দেওয়ার সময় ও সুযোগ পেলেন কই ক্রিকেটাররা! চিপকের নেটে যে উইকেট বাংলাদেশ দলকে দেওয়া হয়েছে, তাতে গতি নেই বললেই চলে। এক ক্রিকেটার মজা করে বলছিলেন, ‘এখানে দিয়েছে স্লো উইকেট, মাঠে গেলে বল আসবে জোরে জোরে।’ কথায়–কথায় দুই দলের টিম হোটেলের দূরত্বের বিষয়টিও চলে এল। মাঠ থেকে বাংলাদেশ দলের হোটেল বাসে চড়ে গেলে প্রায় ৫০ মিনিটের দূরে, আর ভারতেরটা ৫ মিনিটের। বাংলাদেশ প্রচণ্ড গরমে খেলে প্রায় এক ঘণ্টা বাসে বসে থাকবে। ভারতের খেলোয়াড়েরা ততক্ষণে আইস বাথ সেরে বিশ্রামে।
দ্বিপক্ষীয় সিরিজে স্বাগতিক দেশের এমন কূটকৌশলগুলো অবশ্য মেনেই নেয় দলগুলো। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। তবে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেশটাতে এলে মনে হবে, শুধু মাঠের ১১ জন নয়, পুরো ভারতের বিপক্ষেই বুঝি লড়তে হবে। আর তাতে প্রতিপক্ষ দলের জয়ের সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।
ভারতের টিভি চ্যানেল দেখলে নাকি বাংলাদেশ দলের এক ক্রিকেটারের এ রকমই মনে হয়। বাস্তবতা আসলে অনেকটা সে রকমই। দুই দিন ধরে শুধু বাংলাদেশ দলের ২০১৯ সালের ভারত সফরে ভরাডুবির দৃশ্যই দেখানো হচ্ছে। ওই ক্রিকেটার তাই হতাশ কণ্ঠে বলছিলেন, ‘ওরা মারছে আর আমরা আউট হচ্ছি। এই একই জিনিস দেখিয়ে (টেলিভিশনে) যাচ্ছে বারবার!’
ওরা মারছে আর আমরা আউট হচ্ছি। এই একই জিনিস দেখিয়ে (টেলিভিশনে) যাচ্ছে বারবার!
বাংলাদেশ দলের এক ক্রিকেটার
ওই ক্রিকেটারের ভাষায়, সবকিছুতেই বাংলাদেশকে চাপে রাখা আসলে খেলার আগে ভারতের একটা ‘মেন্টাল গেম’। তবে এই চেন্নাইয়েরই একজন মানুষ আছেন, যাঁকে কিছুটা হলেও বাংলাদেশ দলের শুভাকাঙ্ক্ষী ধরা যায়, শ্রীধরন শ্রীরাম। ভারতের সাবেক এই ক্রিকেটার বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ। তাঁর শহরে তাঁরই সাবেক দল বাংলাদেশ সব প্রতিবন্ধকতা জয় করুক, শ্রীরামের সেটাই চাওয়া, ‘তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার দারুণ মিশ্রণ আছে দলটায়। ওরা পাকিস্তানে ভালো করে এসেছে, এখানেও ভালো করা উচিত।’
মাঠ ও মাঠের বাইরের সবকিছুতেই যে অন্য রকম এক পরীক্ষার আবহ, টেস্ট ক্রিকেট তো আসলে এটাই। এক যুগের বেশি সময় ধরে যে পরীক্ষায় সবচেয়ে ধারাবাহিক দলটার নাম ভারত।