ফুটবল চিরন্তন আবেগের নাম। খেলোয়াড়েরা সেই আবেগ ধারণ করেন, দর্শকেরাও করেন, তবে দর্শকদের আবেগের যেন কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। প্রিয় দলের হার-জিতে আবেগ উপচে পড়ে। আর রকমফের আছে দর্শকের মধ্যেও। একদল দর্শক আসেন কেবলই আনন্দ নিতে। গ্যালারির এক কোণে বসে উপভোগ করেন খেলা। আরেক দল আছেন, যাঁরা খেলাটাকে স্রেফ খেলা হিসেবে দেখেন না। তাঁদের আবেগের ক্যানভাস আরও বড়। সেই ক্যানভাসে রয়েছে বিশালাকার তিফো, ব্যানার ও বাদ্যযন্ত্র।
সেই বাদ্যযন্ত্রে ওঠা ঝংকারে কাঁপে গ্যালারি। আতঙ্কও ছড়ায় প্রতিপক্ষ দলের ভক্তদের মধ্যে। তখন তাঁরা আর শুধু ‘ফ্যান’ বা ভক্ত থাকেন না, হয়ে ওঠেন ‘ফ্যানাটিক’(দলান্ধ)। ফুটবলীয় ভাষায় তাঁদের একটি নামও আছে—আলট্রাস। ইউরোপিয়ান ও দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলে আলট্রাসদের উপস্থিতি অনেক আগে, আর বাংলাদেশে আবির্ভাব ঘটেছে সম্প্রতি।
বাংলাদেশের আলট্রাসদের সম্পর্কে জানার আগে এই সমর্থকদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরেকটু জেনে নেওয়া যাক। জেনে নেওয়া যাক তাঁদের উদ্ভব ও বিকাশও।
এই উগ্র সমর্থকদের নিয়ে উরুগুয়ের প্রখ্যাত সাহিত্যিক এদুয়ার্দো গালিয়ানো তাঁর বিশ্বখ্যাত বই ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’তে লিখেছেন, ‘খেলা দেখা তাদের জন্য যেন মৃগীরোগে আক্রান্ত হওয়ার মতো। খেলা তারা আসলে কখনো মনোযোগ দিয়ে দেখেই না। গ্যালারিজুড়েই তাদের সব রাজত্ব। এটাই তাদের কুরুক্ষেত্র। সেখানে প্রতিপক্ষ দলের কারও উপস্থিতিও তাদের বারুদের মতো উসকে দেয়।’
ফুটবল খুব ছোঁয়াচে খেলা। এই খেলার রূপ-রস-আবেগ মাঠের খেলোয়াড়দের থেকে ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারির দর্শকদের মধ্যেও। জন্ম হয় নানাবিধ সমর্থকগোষ্ঠীর। তবে এমন সব গোষ্ঠীর আবির্ভাব মোটেই বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সমর্থকদের এই আবেগও একেবারে শিকড়হীন নয়। একটি নির্দিষ্ট ভূমি ও জনগোষ্ঠীর রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রথা ও যাপনের সঙ্গে এর নিবিড় সংযুক্তি আছে। এ উপাদানগুলো সব সময় তাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে এবং ছায়া হয়ে সামনে এগিয়েও নিচ্ছে।
‘আলট্রাস’ ইতালিয়ান শব্দ হলেও এর অর্থ ইংরেজি ‘হুলিগান’–এর কাছাকাছি। বাংলায় যার অর্থ—‘গুন্ডাগিরি’। ইংরেজিতে অর্থটি সহিংসতা ছড়ানো বোঝানো হলেও ইতালিতে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে উগ্র জাতীয়তাবাদ, উগ্র ডানপন্থা এবং বর্ণবাদী আচরণ।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপীয় এই ভাবধারার বিপরীতে বাংলাদেশের আলট্রাসদের অবস্থান কোথায়?
এ দেশে আলট্রাসদের উত্থান মূলত বিশেষ একটি আন্দোলনকে ঘিরে। করোনা–পরবর্তী সময়ে বাফুফের সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে ‘সালাহউদ্দিন হটাও’ আন্দোলনকে ঘিরে শুরু হয় বাংলাদেশের আলট্রাসদের যাত্রা। আন্দোলন দিয়ে শুরু হলেও সেটা আন্দোলনেই আটকে থাকেনি। এরপর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের হোম ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় গ্যালারিতে আলট্রাসদের পথচলা। ফুটবল যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের আবেগ ও হৃদয়ের সঙ্গে জড়িয়ে, তাই আলট্রাসদের দল ভারী হতেও সময় লাগেনি।
বর্তমানে বাংলাদেশের আলট্রাসদের সদস্যসংখ্যা ১০ হাজার ৮৭৮। বাংলাদেশের ফুটবলের প্রসার ও বর্তমান অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এ সংখ্যা বেশি না হলেও একেবারে কমও নয়। যদিও এটুকুতে আটকে থাকতে চায় না আলট্রাসরা। সদস্যসংখ্য বাড়ানো নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ আলট্রাসের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইয়াসিন মোল্লা বলেন, ‘এই সংখ্যা আরও বাড়বে। কারণ, আমরা এখনো সবাইকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে পারিনি। আশা করি, শিগগিরই এটা সম্ভব হবে এবং আমাদের নিবন্ধনপ্রক্রিয়া এখনো চলমান।’
প্রশ্ন হচ্ছে, যে কেউ চাইলেই কি আলট্রাসে যোগ দিতে পারবেন? এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইয়াসিন বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য সদস্য ফরম পূরণ করতে হবে। থাকতে হয় দেশীয় ফুটবলের প্রতি প্রেম। পাশাপাশি অবশ্যই আমাদের নিয়মকানুন মেনে চলতে রাজি হলেই কেবল আবেদনগুলো অনুমোদন দেওয়া হয়। এর ফলস্বরূপ আমাদের সদস্যরা মাঠে এককভাবে কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে না। আমরা দলীয়ভাবেই উদ্যাপন করি। আমরা যা প্রতিবাদ করি, তা–ও দলীয়ভাবেই করি।’
আলট্রাসদের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, তারা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে। বৈশ্বিকভাবে আলট্রাসরা এসবের জন্য বেশ কুখ্যাত। ইউরোপে শনি-রোববার (লিগের খেলার দিন) অনেক সময় সাধারণ মানুষকে আলট্রাসদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত থাকতে হয়। বাংলাদেশের আলট্রাসরাও কি তেমনই? এ প্রশ্নের উত্তরে কোনো রাখঢাক নেই বাংলাদেশের আলট্রাসদের। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসানের মুখ থেকেই উত্তরটা শোনা যাক, ‘আলট্রাস মূলত উগ্র হয়ে থাকে। তারা ৯০ মিনিট গ্যালারিতে নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজ দলের খেলোয়াড়দের অনুপ্রেরণা ও প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের মনে ভয় ঢোকানোর চেষ্টা করে, আমরাও এর ব্যতিক্রম নই।’
তবে গ্যালারির বাইরে বাংলাদেশ আলট্রাসদের আতঙ্ক তৈরির কোনো উদ্দেশ্য নেই বলে জানিয়েছেন মেহেদী হাসান, ‘আশা করি, গ্যালারির বাইরে দেশের মানুষকে আমাদের জন্য আতঙ্কে থাকতে হবে না। কারণ, আমরা আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটা বুঝি এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে সম্মান করি। তাই সাংগঠনিকভাবে সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডেও আমরা জড়িত। আমাদের আছে নিজস্ব ব্লাড ব্যাংক, যার মাধ্যমে আমরা সমাজের অসুস্থ রোগীদের সহায়তা করতে সব সময় প্রস্তুত। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় যেকোনো সংকট, যেমন বন্যা কিংবা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে জরুরি ত্রাণ সরবরাহসহ উদ্ধারকাজে অংশ নিতে আমাদের সব সময় একটি বিশেষ দল প্রস্তুত থাকে। গত আন্দোলন এবং বন্যা পরিস্থিতিতেও এই দল সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে।’
বৈশ্বিক আলট্রাসরা জাতীয় দলের চেয়ে ক্লাবগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেয়। মূলত ক্লাবের সমর্থকদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উগ্র সমর্থকে রূপান্তরিত হতে দেখা যায়। নামে না থাকলেও একসময় বাংলাদেশে আবাহনী ও মোহামেডানের এমন উগ্র সমর্থকগোষ্ঠী ছিল। এমনকি মারামারিতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটত প্রায়। সেই রক্তারক্তি অবশ্যই কাম্য নয়। কিন্তু ক্লাব ফুটবলের সেসব দিন ফেরাতে আলট্রাসদের ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। বাংলাদেশের আলট্রাস অবশ্য সেই লক্ষ্যে কাজও করে যাচ্ছে। জাতীয় দলের খেলায় ক্লাবের বিরোধিতা ভুলে একসঙ্গে গলা মেলায় তারা। কিন্তু এর বাইরে সারা বছর ক্লাব ফুটবলকে চাঙা রাখতে কাজ করছে তারা। অর্থাৎ জাতীয় দলের জন্য বন্ধু হলেও ক্লাব তাদের আলাদা করে দেয়। সে ক্ষেত্রে একে অপরের বিপক্ষেই দাঁড়ায় তারা।
নতুন বাংলাদেশে আলট্রাস এখন ফুটবল নিয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখে। বাফুফের বিপরীতে একটা ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে কাজ করতে চায়। পাশাপাশি নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করার কাজও করছে তারা। এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে আলাদা লোগো, গানও। মাঠের বাইরে এ মুহূর্তে আলট্রাসদের মূল লক্ষ্য বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন ও তাঁর সহযোগীদের সরানো। এ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচিও পালন করছে তারা। সালাহউদ্দিন হটাও কর্মসূচি নিয়ে মেহেদী হাসান বলেন, ‘যারা দেশের ফুটবল নিয়ে ভাবে, তারা দায়িত্বে আসুক এবং ফুটবল নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করুক। যা দেশের ফুটবলের জন্য মঙ্গলকর হবে।’
শুধু এটুকুই নয়, ফুটবলকে নিয়ে আলট্রাসদের স্বপ্ন আরও বড়। লম্বা সময় ধরে ফুটবলে বিমুখ হয়ে পড়া প্রজন্মকে নতুন করে ফুটবলের দিকে ফেরাতে চায় তারা। নিজেদের স্বপ্ন নিয়ে মেহেদী বললেন, ‘আমাদের চাওয়া দেশের ফুটবলের উন্নতি। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম আমাদের এই প্রজন্মের কাছে দেশের ফুটবলের বার্তা ঠিকভাবে পৌঁছাতে পারেনি। যার ফলে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও একটা গোটা প্রজন্ম দেশের ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। তৈরি হয়েছে একটা জেনারেশন গ্যাপ।আমরা এই গ্যাপটাকে দূর করতে চাই। যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের মতো বঞ্চিত না হয়। এ জন্য আমরা বাফুফেতেও খোঁড়া ও মান্ধাতার আমলের চিন্তাসম্পন্ন দুর্নীতিবাজ কাউকে চাই না। আধুনিক ফুটবল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং আধুনিক ফুটবলজ্ঞানসম্পন্ন উন্নত রুচিশীল ব্যক্তিত্ব চাই, যারা দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পরিকল্পনা করে এবং বাস্তবায়ন করতে পারবে, সেই যোগ্যতা রাখে।’
আলট্রাসদের নিয়ে যতই আলোচনা-সমালোচনা থাকুক, এটা অন্তত কেউ অস্বীকার করবে না যে বাংলাদেশের ফুটবলের এখন ঘুরে দাঁড়ানো জরুরি। সেই ঘুরে দাঁড়ানোর পথে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমর্থকদের মাঠমুখী করা। আলট্রাসরূপেও যদি হারিয়ে যাওয়া সেই ফুটবলপ্রেমীরা মাঠমুখী হন, সেটা তো দেশের ফুটবলের জন্যই মঙ্গল!