ইতিহাসের প্রথম চ্যাম্পিয়নস ট্রফিটা হয়েছিল বাংলাদেশেই। উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ, এই পোশাকি নামের টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ অবশ্য দর্শক হয়েই ছিল। ঘরের মাঠে সুযোগ না হলেও ২০০০ সালে কেনিয়ায় দ্বিতীয় আসরে প্রথমবারের মতো খেলতে নামে বাংলাদেশ। ২০০৬ সাল পর্যন্ত টানা চারটি টুর্নামেন্ট খেলা বাংলাদেশ সুযোগ পায়নি ২০০৯ ও ২০১৩ সালে। ২০১৭ সালে ফিরেই সেমিফাইনালে ওঠা বাংলাদেশ এবার খেলছে ষষ্ঠ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি।
২০০০
এই টুর্নামেন্টে প্রথমবার বাংলাদেশ। কেনিয়ার নাইরোবিতে সেই আসরটি ছিল নকআউট কাঠামোর, এক ম্যাচ হারলেই বিদায়! প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। ৬৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কেনিয়া যাওয়া বাংলাদেশ এক ম্যাচ খেলেই বিদায় নেয়। বাংলাদেশ করেছিল ২৩২। আঙুলের চোটে মাঝে প্রায় ১৬ ওভার মাঠের বাইরে থাকা ওপেনার জাভেদ ওমর শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ৬৩ রানে। অধিনায়ক নাসের হুসেইনের ৯৫ আর ওপেনার অ্যালেক স্টুয়ার্টের অপরাজিত ৮৭ রানের ইনিংসে ভর করে ইংলিশরা ৮ উইকেট হাতে রেখে লক্ষ্য পৌঁছে যায়।
২০০২
টুর্নামেন্টের ফরম্যাট বদলে যায় এবার। পুল ১-এ (গ্রুপ পর্ব) বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে দুই পরাশক্তির কাছেই স্রেফ উড়ে যায় বাংলাদেশ। গ্লেন ম্যাকগ্রার নিখুঁত লাইন-লেংথ, জেসন গিলেস্পি ও ব্রেট লির গতি আর শেন ওয়ার্নের ঘূর্ণিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১২৯ রানে গুটিয়ে যায় খালেদ মাসুদের দল। সর্বোচ্চ ৪৫ রান করে অলক কাপালি। ১৭৬ বল ও ৯ উইকেট হাতে রেখেই জিতে যায় অস্ট্রেলিয়া।
পরের ম্যাচের ব্যাটিং–ব্যর্থতা আগেরটিকেও ছাড়িয়ে গেছে। নিউজিল্যান্ড করেছিল ২৪৪ রান। রান তাড়া করতে নেমে শেন বন্ডের তোপে পড়েন ব্যাটসম্যানরা। শেন বন্ডের তোপে ১৯ রানে ৫ উইকেট বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত অলআউট ৭৭ রানে। ১৬৭ রানে হার টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে ফেলে বাংলাদেশকে।
২০০৪
এই আসরের গল্পও এক, শুধু প্রতিপক্ষ আর ভেন্যু আলাদা। ‘বি’ গ্রুপে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে বিশাল ব্যবধানে হেরে শূন্য হাতে বিদায়। তারপরও এই টুর্নামেন্টকে মনে রাখা হয়েছে অন্য কারণে। নিয়মিত অধিনায়ক হাবিবুল বাশার চোটে ছিটকে পড়ায় অধিনায়ক হয়ে যান রাজিন সালেহ। এজবাস্টনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টস করতে নেমেই ইতিহাস গড়েন রাজিন, হয়ে যান ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক (২০ বছর ২৯৭ দিন)। ২০১৮ সালে সেই রেকর্ড ভেঙে দেন আফগানিস্তানের রশিদ খান (১৯ বছর ১৬৫ দিন)।
তবে মাঠে যা হয়েছে, বাংলাদেশের সমর্থকেরা নিশ্চয় তা মনে করতে চাইবেন না। চার্ল ল্যাঙ্গাভেল্ট ও মাখায়া এনটিনির গতি এবং নিকি বোয়ের ঘূর্ণিতে ৯৩ রানেই শেষ বাংলাদেশ। সর্বোচ্চ ৪০ রান করেন নাফিস ইকবাল। গ্রায়েম স্মিথ, হার্শেল গিবস, জ্যাক ক্যালিসদের নিয়ে গড়া প্রোটিয়া ব্যাটিং লাইনআপ লক্ষ্যে পৌঁছায় মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে, ১৯৩ বল বাকি রেখে।
সাউদাম্পটনের পরের ম্যাচে ৩ উইকেটে ২৬৯ রান করে ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্রিস গেইল আউট হন ৯৯ রানে। এরপর মারভিন ডিলনের ক্যারিয়ার–সেরা বোলিংয়ে (৫/২৯) বাংলাদেশ অলআউট মাত্র ১৩১ রানে।
২০০৬
প্রথমবারের মতো ভারতে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টে আবারও ফরম্যাটে আসে বদল। ছয় দল সরাসরি গ্রুপ পর্বে জায়গা পায়। চার দলকে খেলতে হয় কোয়ালিফাইং রাউন্ডে। সেখান থেকে দুটি দল যায় গ্রুপ পর্বে।
শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে বাছাইয়ের প্রথম দুই ম্যাচ হেরেই বিদায় নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের। তবে নিয়মরক্ষার শেষ ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে দেয় হাবিবুল বাশারের দল, যা টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের প্রথম জয়। শাহরিয়ার নাফীসের সৌজন্যে আসরে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিও আসে সেইবার।
জয়পুরে ৬ উইকেটে ২৩১ রান করেছিল বাংলাদেশ। তিন বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান, মোহাম্মদ রফিক ও আবদুর রাজ্জাকের দারুণ বোলিংয়ে জিম্বাবুইয়ানরা অলআউট হয় ১৩০ রানে, বাংলাদেশের জয় ১০১ রানের।
জয়পুরেই আগের ম্যাচে ক্রিস গেইলের সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশকে ১০ উইকেটে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আফতাব আহমেদের ফিফটিতে বাংলাদেশ করেছিল ১৬১ রান। ক্যারিবীয়রা ম্যাচ জিতে নেয় ৮০ বল হাতে রেখে।
নিজেদের প্রথম ম্যাচে অবশ্য ভালোই লড়েছে বাংলাদেশ। মোহালিতে উপুল থারাঙ্গার সেঞ্চুরিতে ৩০২ রান করে শ্রীলঙ্কা। মুত্তিয়া মুরালিধরন, চামিন্ডা ভাস, লাসিথ মালিঙ্গাদের নিয়ে গড়া লঙ্কান বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে কখনোই জয়ের সম্ভাবনা জাগাতে পারেনি হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন দল। তবে পুরো ৫০ ওভার খেলে ২৬৫ রান করা সেই সময় বাংলাদেশের জন্য বড় ব্যাপারই ছিল। সেই ম্যাচেই ৬৭ রানে অপরাজিত থেকে সাকিব প্রথমবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তাঁর আগমনী বার্তা দিয়েছিলেন।
২০১৭
১১ বছর পর চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ফিরেই স্বাগতিক ইংল্যান্ডের সামনে বাংলাদেশ। সেটাও টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচেই। ওভালে তামিম ইকবালের সেঞ্চুরি আর মুশফিকুর রহিমের ফিফটিতে ৬ উইকেটে ৩০৫ রান করে বাংলাদেশ। ২ উইকেট হারিয়েই রানটা পেরিয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে প্রথম দল হিসেবে ৩০০ ছাড়া লক্ষ্য ছুঁয়ে জিতে যায় ইংল্যান্ড।
সেই ওভালেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচটা ছিল বাংলাদেশের জন্য টিকে থাকার লড়াই। কিন্তু মিচেল স্টার্কের গতি আর বাউন্সারে ১৮২ রানেই শেষ বাংলাদেশ। তামিম একাই যা লড়েন (১১৪ বলে ৯৫)। সহজ লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে নিশ্চিত জয়ের পথেই ছিল অস্ট্রেলিয়া। ১৬ ওভারে ১ উইকেট হারিয়ে তারা তুলে ফেলেছিল ৮৩ রান। এরপরই বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে বৃষ্টি। ডিএলএস পদ্ধতিতে অস্ট্রেলিয়া ঢের এগিয়ে ছিল।
কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, ওয়ানডে ম্যাচের ফল হতে হলে দুই দলকেই কমপক্ষে ২০ ওভার করে ব্যাট করতে হয়। বৃষ্টি নামার আগে অস্ট্রেলিয়া ১৬ ওভার ব্যাট করতে পারায় ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। সৌভাগ্যে পাওয়া ১ পয়েন্টের সুবাদে সেমিফাইনালে ওঠার আশা বাঁচিয়ে রাখে বাংলাদেশ।
কার্ডিফে এরপর বাংলাদেশ রূপকথার জন্ম দেয়। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচকে বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা বিবেচনা করা হয়। মাশরাফির নেতৃত্ব আর ইনিংসের শেষ দিকে মোসাদ্দেক হোসেনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে নিউজিল্যান্ডকে ২৬৫ রানে আটকে ফেলে বাংলাদেশ।
কিন্তু তাড়া করতে নেমে ৩৩ রান তুলতেই প্রথম চার ব্যাটসম্যানের বিদায়। পরের গল্পটা সবার জানা। সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহর ২২৪ রানের মহাকাব্যিক জুটি, যা টুর্নামেন্টের ইতিহাসে যেকোনো উইকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দুজনই করেছেন সেঞ্চুরি। জয় থেকে ৮ রান দূরে থাকতে সাকিব আউট হলেও মোসাদ্দেককে নিয়ে বাকি কাজ অনায়াসে সেরেছেন মাহমুদউল্লাহ।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় জয়ের পর বাংলাদেশ তাকিয়ে ছিল বার্মিংহামের এজবাস্টনে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের দিকে। কারণ, অস্ট্রেলিয়া হারলে বা পয়েন্ট হারালেই কেবল সেমিফাইনালে উঠতে পারত বাংলাদেশ। মাশরাফির দলের চাওয়াটাই পূরণ হয়। ডিএলএস পদ্ধতিতে অস্ট্রেলিয়াকে ইংল্যান্ড ৪০ রানে হারিয়ে দেওয়ায় প্রথমবারের মতো শেষ চারে বাংলাদেশ।
এজবাস্টনের সেমিফাইনালে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় ভারতকে। প্রথমবার এত বড় ম্যাচে খেলতে নামার চাপেই কি না রোহিত-কোহলিদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে মাশরাফির দল। তামিম-মুশফিকের ফিফটিতে বাংলাদেশ করেছিল ২৬৪ রান। ভারত লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলে ৯ উইকেট আর ৫৯ বল হাতে রেখে।