দ্যা নিউ ভিশন

এপ্রিল ১৯, ২০২৫ ১৫:৪৯

মোনালিসা নয়, এখন লিটন ‘হাঁস’ই বেশি আঁকছেন

লিটন দাস

‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়’—কথাটিকে অনেক পরিস্থিতিতেই বিশ্লেষণ করা যায়। ক্রিকেটে যেমন, যেটা ঘটার শঙ্কায় থাকবেন, সেটাই কিছু কিছু সময় বারবার ঘটে। বিরাট কোহলির কথাই ধরুন। ব্যাটসম্যান হিসেবে কিংবদন্তি, কিন্তু অফ স্টাম্পের বাইরের বলে তাঁর দুর্বলতা কার অজানা! সামর্থ্যের জায়গা থেকে সে দুর্বলতাও আবার অন্য অর্থে বেশ প্রেমময়—ছাড়তে চান না কিংবা পারেন না!

তাই বারবার ‘ধরা’ খাচ্ছেন। চলতি বোর্ডার–গাভাস্কার সিরিজেই একাধিকবার। এখন কেউ যদি বলেন, অফ স্টাম্পের বাইরে বল দেখে কোহলি বুক কেঁপে ওঠে না, সেটা ভুল কথা! ‘প্রেম’–এর প্রতি সামর্থ্য প্রমাণে ভুলচুক যা–ই হোক, বুক কাঁপেই। লিটন দাসেরও নিশ্চয়ই কাঁপছে। পার্থক্যটা হলো, কোহলি ক্রিজে গিয়ে তবু কিছুক্ষণ দাঁড়াতে পারছেন। লিটনের তো ব্যাটিংয়ে নামতেই বুক কাঁপার কথা। ব্যাট–প্যাড–হেলমেট পরে ড্রেসিংরুম থেকে ক্রিজে যেতে যতক্ষণ লাগে, গিয়ে যে ততক্ষণও থাকতে পারছেন না। তবে একদম খালি হাতেও ফিরতে হচ্ছে না। কারণ, ক্রিকেট কাউকে কখনোই খালি হাতে ফেরায়নি। অন্তত ‘শূন্য’ তো আসছে!

আজও যেমন মিলল সেন্ট ভিনসেন্টের আর্নস ভেল গ্রাউন্ডে। সিরিজের প্রথম টি–টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ অধিনায়ক যখন ব্যাট করতে নামছিলেন, তখন কেউ কেউ আশায় বুকও বেঁধেছেন। যাক, ম্যাচটা তো আর ওয়ানডে নয়—এবার বোধ হয় ফাঁড়া কাটবে! এ বছর ৫ ওয়ানডের তিনটিতেই শূন্য রানে আউট, কিন্তু এবার ম্যাচটা টি–টোয়েন্টি আর লিটন যেহেতু অধিনায়ক—দায়িত্ব নিয়ে খেলবেন, তাই শূন্যের পর শূন্য হবে না। কিন্তু কিসের কি, সেই শূন্যের ভয়ই ফিরে এল সোনালি শূন্য হয়ে—গোল্ডেন ডাক! প্রথম বলেই বোলার আকিল হোসেনকে ক্যাচ শিখিয়ে লিটন যখন ফিরছিলেন, তখন এই দুনো শীতে তাঁর নামের পাশে দুটো উনো ‘সোনালি হাঁস’!

কীভাবে বলছি। টি–টোয়েন্টিতে অধিনায়ক লিটনের এটি দ্বিতীয় ম্যাচ। প্রথমটি ২০২১ সালে অকল্যান্ডে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। আজকের মতো সেই তিনে নেমেই আউট হয়েছিলেন প্রথম বলে। টিম সাউদিকে প্যাডল করতে গিয়ে বোকা বনেছিলেন। তবে বাঙালি যেহেতু চিরকালই খুব আশাবাদী, আর ম্যাচটা হয়েছিল ১ এপ্রিল, কেউ কেউ হয়তো ‘স্রেফ এপ্রিল “ফুল” (বোকা) এর মারপ্যাঁচ’—ভেবে সান্ত্বনা খুঁজে নিয়েছিলেন।

তিন বছরের বেশি সময় পর সেই একই সংস্করণের ম্যাচে এপ্রিল নেই, ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে ফুলের সৌরভে শুধু ‘ফুল’টা থাকল। নাহ, এ ফুল পাপড়িশোভিত সেই ফুল নয়, এ ফুল ইংরেজির ‘ফুল’—আর এবারও বোকা বনে লিটনের হাতে যা উঠল, তা আগেই বলা হয়েছে। তবু ধরতে না পারলে, নস্টালজিক বাঙালিকে একটি স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়। ১৯৯২ বিশ্বকাপে কিংবা নব্বইয়ের দশকে অস্ট্রেলিয়ায় কোনো টুর্নামেন্টে ব্যাটসম্যান রান না করে আউট হয়ে ফিরলে চ্যানেল নাইনের স্ক্রিনের নিচে একটি হাঁসকে কেঁদেকেটে ব্যাট ছুড়ে ফিরতে দেখা যেত। লিটনের ‘হাঁস’টার রং সোনালি, এই যা!

নস্টালজিয়া! আহা, বাঙালির বড় পছন্দের বিষয়। তা, লিটনের এই ‘ডাক’ কিংবা ‘হাঁস’–এর ডানার কী ক্ষমতা দেখুন, একেবারে ‘টাইম ট্রাভেল’ করিয়ে ছাড়ল! ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’ সিনেমার মতো শোঁ করে একদম কুড়ি বছর পেছনে। লিটনের আগে এক বছরে সব সংস্করণ মিলিয়ে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের ন্যূনতম ৬টি ‘ডাক’ সর্বশেষ দেখা গিয়েছে ২০০৪ সালে। ওহ, বলাই হয়নি, এই বছর এখন পর্যন্ত সব সংস্করণ মিলিয়ে লিটনের ‘হাঁস’সংখ্যা সমান ক্রিকেটের একটি ছক্কা—৬টি।

যাহোক, কুড়ি বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক। ২০০৪ সালে রাজিন সালেহ মেরেছিলেন ৮টি ‘ডাক, আর মোহাম্মদ আশরাফুল মেরেছিলেন ৭টি ‘ডাক’। তারপর এই ২০ বছরে বাংলাদেশের আর কোনো ব্যাটসম্যান এতগুলো ‘ডাক’ শিকার করতে পারেননি। লিটনও এখন পর্যন্ত তাঁদের মতো পারেননি, তবে হতাশ হলে চলবে না। সুযোগ চলে যায়নি। চলতি সিরিজে আরও দুটো টি–টোয়েন্টি খেলে বছর শেষ করবে বাংলাদেশ। ভয়টা যেহেতু বারবার ফিরে আসছে, তাই আশায় বুক বাঁধাই যায়!

সেই আশায় ডুবুন আর না ডুবুন, প্রশ্ন তো একটি থেকেই যায়। এক বছরে বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ‘ডাক’সংখ্যা কার? বাঁহাতি সাবেক পেসার মঞ্জুরুল ইসলামের। ২০০২ সালে ২০ ম্যাচে ২৩ ইনিংসে ৯টি ‘ডাক’ ছিল তাঁর। আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি যেহেতু ২০০৫ সালে এসেছে, তাই ২০০২ কিংবা ২০০৪ সালের পরিসংখ্যানগুলো টেস্ট ও ওয়ানডের।

এ বছর এখন পর্যন্ত তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৩৩ ম্যাচে ৩৯ ইনিংসে লিটনের ‘ডাক’ হলো ৬টি। অর্থাৎ তাঁর ৯ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের মধ্যে প্রতিবছর বিবেচনায় এ বছরই ‘হাঁস ফলন’ সবচেয়ে ভালো।

তবে দুই বছর আগেই ৮ ম্যাচে ১৫ ইনিংসে ৮টি ‘ডাক’ মারার নজির গড়ে রেখেছেন পেসার খালেদ আহমেদ। এক বছরে ৭টি করে ‘ডাক’ মারার নজির আছে তালহা জুবায়ের, মুশফিকুর রহমান, শাহাদত হোসেন, শফিউল ইসলাম ও রুবেল হোসেনের। তবে তাঁরা কেউ তো রাজিন কিংবা আশরাফুলের মতো আর ব্যাটসম্যান নন। লিটনের সঙ্গে ‘টাইম ট্রাভেল’ তাই সত্যি সত্যিই নস্টালজিক, তাই না!

যদি তা–ই হয়, তবে এবেলা বর্তমানে ফেরা যাক। লিটনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এটি নবম বছর। এর আগে তিন সংস্করণ মিলিয়ে এক বছরে তাঁর সর্বোচ্চ ‘ডাক’সংখ্যা ৫টি করে। ২০২১ সালে ৩৫ ম্যাচে ৩৯ ইনিংসে ডাক ছিল ৫টি। আর গত বছর ৪০ ম্যাচে ৪১ ইনিংসেও ৫টি। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন, এ বছর কী কাণ্ডটা ঘটে গেছে!

এ বছর এখন পর্যন্ত তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৩৩ ম্যাচে ৩৯ ইনিংসে লিটনের ‘ডাক’ হলো ৬টি। অর্থাৎ তাঁর ৯ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের মধ্যে প্রতিবছর বিবেচনায় এ বছরই ‘হাঁস ফলন’ সবচেয়ে ভালো। ব্যাটিং গড়ও এ বছরই সবচেয়ে বাজে (১৮.২১)।

দল প্রথম টি–টোয়েন্টি জিতলেও ভয়টা তাই থেকেই যাচ্ছে। জয়ের পর ম্যাচসেরা মেহেদী হাসান তাঁর অধিনায়কের ব্যাটিং নিয়ে বলেছেন, ‘এটা নিজের কাছে। যে খারাপ খেলে, সে বোঝে তার ভেতরে কেমন চলে।’

অর্থাৎ আমরা শুধু আন্দাজই করতে পারি। আচ্ছা, লিটন রাতে ঘুমোতে পারছেন তো? শান্তির ঘুম যে তাঁর এখন বড্ড প্রয়োজন। একে তো অধিনায়ক, তার ওপর দলের মধ্যে ব্যাট হাতে তাঁর হাতটাই নাকি তুলি হয়ে ওঠে! সেই ‘তুলি’ হাতে লিটন ২২ গজে গত দুই ম্যাচে যা–ই আঁকার চেষ্টা করেছেন, সেটাই ‘হাঁস’ হয়ে ফুটেছে! এভাবে আর যা–ই হোক ঘুম হওয়ার কথা নয়।

ঘুমের ঘোরে তাঁর হাঁসের ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনার কথা!

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ

ছাত্রদলের অনুষ্ঠানে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি, ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার আশা

ছাত্রশিবির, ছাত্রদলসহ যাঁরা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন, তাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী