আওয়ামী লীগের তৈরি আইনেই শেখ হাসিনার বিচারের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অতীতের মতো এই ট্রাইব্যুনাল নিয়েও বিতর্ক উঠতে শুরু করেছে।
নানা প্রশ্নের মুখে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় ৮ দফা সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া নিয়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় একটি মতবিনিময় সভা করেছে; কিন্তু সংস্কার করার আগেই ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল প্রাক্–বিচারপ্রক্রিয়া বা বিচারের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছেন।
আইনজীবীদের অনেকে মনে করেন, আইনের সংস্কার না করেই আওয়ামী লীগ আমলের আইনেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করায় এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার কথা বলা হয়েছে। এই আইন সংস্কার না করে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার করা হলে বিতর্ক উঠতে পারে।
তবে সরকার বলছে, ট্রাইব্যুনালের প্রাথমিক কাজ শুরু এবং আইন সংশোধনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাক্–বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই পর্যায়ে আইন সংশোধন না করলে সমস্যা নেই। বিচারকাজ শুরু হলে তখন আইনের সংশোধনী করা না হলে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। সেটি বিবেচনায় রেখেই সরকার কাজ করছে।
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে এ পর্যন্ত কয়েকবার সংশোধনী আনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ সালে এ আইনে প্রথমবার সংশোধনী এনে আইনটি মূলত হালনাগাদ করা হয়। এর পর ২০১২ সালে দ্বিতীয় সংশোধনী এনে আসামির অনুপস্থিতিতে তাঁকে পলাতক ঘোষণা করে বিচার এবং এক ট্রাইব্যুনাল থেকে আরেক ট্রাইব্যুনালে (প্রথমে ট্রাইব্যুনাল ছিল একটি, পরে দুটি করা হয়) মামলা স্থানান্তরের বিধান যুক্ত করা হয়। ২০১৩ সালে সর্বশেষ সংশোধনী আনা হয়। এর ফলে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিলের সমান সুযোগের বিধান যুক্ত হয়।
আইনজীবীদের অনেকে মনে করেন, আইনের সংস্কার না করেই আওয়ামী লীগ আমলের আইনেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করায় এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বর্তমান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭৩ সালের আইনটিতে যেকোনো সময় সংঘটিত গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। ফলে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক তৈরির কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া এখন প্রাথমিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে আইন সংস্কারের কোনো সম্পর্ক নেই।
সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ের মতবিনিময় সভায় সংস্কারের বিষয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় গুম ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা যুক্ত করার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। পাশাপাশি কোনো রাজনৈতিক দল যদি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করে, তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটিসহ আইনে পাঁচটি ধারা-উপধারা সংযোজন এবং তিনটি ধারা সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাক্–বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই পর্যায়ে আইন সংশোধন না করলে সমস্যা নেই। বিচারকাজ শুরু হলে তখন আইনের সংশোধনী করা না হলে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। সেটি বিবেচনায় রেখেই সরকার কাজ করছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে প্রশ্ন
হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এবং আরও দুজন বিচারক নিয়োগ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়েছে গত সোমবার। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুজন সদস্য হলেন, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কেন আন্তর্জাতিক বিচারক নিয়োগ করা প্রয়োজন, এই শিরোনামে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান প্রথম আলো অনলাইনের ইংরেজি ভার্সনে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। এতে তিনি পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
ডেভিড বার্গম্যান লিখেছেন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার জেলা আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক; মাত্র ছয় দিন আগে হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। আর মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ। এ ছাড়া শফিউল আলম মাহমুদ আইনজীবী থেকে মাত্র ছয় দিন আগে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি বিএনপি–সমর্থিত আইনজীবী ফোরামে সম্পৃক্ত ছিলেন।
এসব বিষয় উল্লেখ করে ডেভিড বার্গম্যান লিখেছেন, এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে। তিনি তাঁর লেখায় একতরফা বিচার যাতে না হয়, সে জন্য আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে ধারণা আছে, এমন বিদেশি বিচারক নিয়োগের পরামর্শও দিয়েছেন।
তবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এ বিষয়ে বলেন, অতীতে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকলে কেউ নিরপেক্ষভাবে কাজ করবেন না, এটা সঠিক নয়। তা ছাড়া বাংলাদেশের আইনে বিদেশি বিচারক নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই।