অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, খুনের মামলার আসামি ও তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি—এই তিন শ্রেণির মানুষকে সব সময় নিজের আশপাশে রাখতেন কুমিল্লা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার। যে কারণে মানুষ তাঁকে ভয় পেত। এর মধ্য দিয়ে কুমিল্লা শহর ও আশপাশের এলাকার রাজনীতি ও অপরাধ—দুটোই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। তাঁর দাপট এতটাই ছিল যে আওয়ামী লীগের নেতারাও এখন বলছেন, কুমিল্লা শহরে কোনটি ‘ন্যায়’ আর কোনটি ‘অন্যায়’, সেটিও তিনি ঠিক করতেন। তিনি যেন কুমিল্লায় দুর্বৃত্তায়নের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
গত ১৫ বছরে আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার নিজের অনুসারী ও ঘনিষ্ঠজনদের দলীয় বিভিন্ন পদে বসিয়েছেন। তাঁদের অনেককে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ নেতাদের বঞ্চিত করে নিজের মেয়ে তাহসীন বাহারকে প্রথমে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক করেন। গত মার্চ মাসে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের উপনির্বাচনে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তাহসীনকে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী ঘোষণা করেন তিনি।
গত ১৫ বছর কুমিল্লায় কোনটি ‘ন্যায়’ আর কোনটি ‘অন্যায়’, সেটিও ঠিক করতেন বাহার। দখল, চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিজ দলের বিরোধী পক্ষকে দমনসহ নানা অপকর্ম করেছেন বাহারের ঘনিষ্ঠরা। গত ১৫ বছরে কুমিল্লা শহরে অন্তত পাঁচজন দলীয় নেতা-কর্মী খুনে বাহারের সহযোগীরা সরাসরি জড়িত।
তবে মেয়র হলেও তাহসীন বেশি দিন দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাবা বাহারের সঙ্গে তিনিও পালিয়ে যান। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহার প্রথম সংসদ সদস্য হন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এর পর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আরও তিনবার কুমিল্লা-৬ (আদর্শ সদর, সিটি করপোরেশন ও কুমিল্লা সেনানিবাস) আসনের সংসদ সদস্য হন তিনি।
মহানগর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের ১১ জন নেতার সঙ্গে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে কুমিল্লায় গিয়ে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, বাহারের বিরোধিতা করায় গত ১৫ বছরে হামলার (কাউকে কোপানো হয়েছে, কাউকে গুলি করা হয়েছে) শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২০ নেতা-কর্মী। তাঁদের মধ্যে ৭ জনের কারও হাতের, কারও পায়ের কর্মক্ষমতা হারিয়ে গেছে। গত ১৫ বছর কুমিল্লায় কোনটি ‘ন্যায়’ আর কোনটি ‘অন্যায়’, সেটিও ঠিক করতেন বাহার। দখল, চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিজ দলের বিরোধী পক্ষকে দমনসহ নানা অপকর্ম করেছেন বাহারের ঘনিষ্ঠরা। গত ১৫ বছরে কুমিল্লা শহরে অন্তত পাঁচজন দলীয় নেতা-কর্মী খুনে বাহারের সহযোগীরা সরাসরি জড়িত।
কুমিল্লা ক্লাবের নিয়ন্ত্রণও বাহারের কাছে ছিল। তাঁর সম্মতি ছাড়া কেউ কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য হতে পারতেন না। আর ঐতিহ্যবাহী টাউন হল ভেঙে বাহার বহুতল বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করছিলেন।
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নূর উর রহমান মাহমুদ (তানিম) একসময় বাহারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কুমিল্লায় ঠিকাদারি, দখলবাজি থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপকর্ম করেছেন বাহার। তাঁর বিরোধিতা করায় দলের অনেক নেতা-কর্মীকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে গেছেন। কয়েকজন খুনও হয়েছেন। এসব ঘটনার পেছনের লোকটি সাবেক সংসদ সদস্য বাহার।
গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পরপরই বিক্ষুব্ধ জনতা কুমিল্লা শহরের মুন্সেফবাড়ি এলাকায় বাহারের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেন। বাড়ির গ্যারেজে থাকা তিনটি গাড়িও তখন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আগুন দেওয়া হয় কুমিল্লা শহরের রামঘাট এলাকায় আওয়ামী লীগের নতুন কার্যালয়েও (১০ তলা ভবন)। বিরোধপূর্ণ জমি দখলে নিয়ে দলীয় কার্যালয় নির্মাণ করেছিলেন বাহার। ওই দিন বিক্ষুব্ধ জনতা কুমিল্লা ক্লাব এবং টাউন হলেও আগুন দিয়েছেন। কুমিল্লা ক্লাবের নিয়ন্ত্রণও বাহারের কাছে ছিল। তাঁর সম্মতি ছাড়া কেউ কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য হতে পারতেন না। আর ঐতিহ্যবাহী টাউন হল ভেঙে বাহার বহুতল বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করছিলেন। এ নিয়েও স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ ছিলেন। ফলে আওয়ামী লীগের পতনের পর বিক্ষুব্ধ লোকজন এসব স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছেন।
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক আনিসুর রহমান (মিঠু) প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতায় থেকে কুমিল্লায় চূড়ান্ত পর্যায়ের দুর্বৃত্তায়ন করেছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য বাহার। এ কারণেই তাঁকে কুমিল্লা থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। নিজের কৃতকর্মের জন্যই একজন রাজনীতিবিদের এমন পরিণতি হয়েছে।
বাহারের উত্থান ও খুনের রাজনীতি
স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে কুমিল্লা শহরকেন্দ্রিক আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও অপরাধজগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন আফজল খান। তখন তাঁর অনুসারী ছিলেন বাহার। তখন তিনি কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। টাকার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে আশির দশকের শুরুর দিকে আফজল খানের সঙ্গে বাহারের বিরোধ হয়। ওই সময় কুমিল্লার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে বাহারের প্রভাব ছিল।
আশির দশকে কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন আফজল খান, বাহার ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আফজল খানের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে বাহার জয়ী হন। আফজল খানের বিরোধীরা এককাট্টা হয়ে ওই নির্বাচনে বাহারকে জয়ী করেছিলেন।
১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাহার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে কুমিল্লা সদর আসন থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন। ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পরে কুমিল্লা শহরে বাহারের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৯৮ সালে বাহারের অনুসারী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে নিহত হন জাহিদুর রহমান ভূঁইয়া ওরফে বাবু। এই খুনে জড়িত ব্যক্তিদের সবাই বাহারের অনুসারী। এ ঘটনার তিন বছর পর ২০০১ সালের জুলাই মাসে কুমিল্লা শহরের টমছমব্রিজ এলাকায় খুন হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক ওরফে দুলাল। এই খুনের ঘটনায় করা মামলায় বাহারকে আসামি করা হয়। অন্য আসামিদের মধ্যে ছিলেন বাহারের ঘনিষ্ঠ কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরফানুল হক রিফাত, কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম ওরফে রিন্টু এবং কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ নেওয়াজ পাভেল। যদিও পরবর্তী সময়ে সাক্ষীর অভাবে এই মামলায় সব আসামি খালাস পান।