গণতন্ত্রবিরোধী ফ্যাসিস্ট শক্তি আওয়ামী লীগ নির্বাচনের জন্য যোগ্য কি না, সেটি জনগণই নির্ধারণ করবে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তবে তিনি বলেছেন, ‘যারা ফ্যাসিস্ট, যারা স্যাডিস্ট, যারা আন্দোলনকারী গণতন্ত্রকামী মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, যারা ৫ আগস্টের বিদায়ের আগমুহূর্তে মানুষ মেরে মৃত দেহকে আগুনে পুড়ে ছাই করে দিতে পারে, যারা হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে দেশের মানুষকে হত্যা করতে পারে, মৃতদেহের ওপর নাচানাচি করতে পারে, তাদের সঙ্গে কখনো গণতন্ত্র যায় না।’
আজ সোমবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) বার্ষিক সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মিয়া গোলাম পরওয়ার এ কথা বলেন।
উপস্থিত সাংবাদিক, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘গণতন্ত্রবিরোধী এই ফ্যাসিস্ট শক্তি (আওয়ামী লীগ) নির্বাচনের জন্য যোগ্য কি যোগ্য না, এটা আপনারাই নির্ধারণ করবেন। কিন্তু তাদেরই গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করার সুযোগ আছে, যাদের রাজনৈতিক আদর্শে গণতন্ত্র আছে। যাদের হাতে গণতন্ত্র নিরাপদ নয়, এ দেশের অখণ্ডতা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কোনো কিছুই নিরাপদ নয়, তাদের ব্যাপারে জনগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।’
জামায়াতের সেক্রেটারি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তো সেই দল, শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় আসার আগে যিনি যে গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, শোষণ-জুলুমের-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে গণতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তিনি গণতন্ত্রের সিঁড়িটা নিজেই ফেলে দিয়েছিলেন। ক্ষমতায় ওঠা ও নামার যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, সংসদীয় গণতন্ত্রকে নিজেই ভাঙচুর করে চিরদিনের মতো পারিবারিক কর্তৃত্বের একদলীয় বাকশাল শাসন কায়েম করেছিলেন। এটা কি গণতন্ত্রের সঙ্গে যায়?’
‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে নিঃশেষ করে দিতে পারি’
আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে রাজনৈতিকভাবে নিঃশেষ করে দেওয়ার পন্থা অবলম্বন করার কথা বলেন জামায়াতের এই নেতা। সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এক দফার আন্দোলনে আমরা রক্ত দিয়েছি, আমাদের ছেলেরা জীবন দিয়েছে। এখন জাতীয় পলিসি নির্ধারণে জাতীয় নির্বাচন আসছে। এখানেও আমি মনে করি, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি চিন্তার ঐক্য থাকতে হবে, অনেক নির্বাচনী কলাকৌশল আছে। জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে আমরা এমন একটা নির্বাচনী পন্থা অবলম্বন করতে পারি, যে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে রাজনৈতিকভাবে এখানে আমরা নিঃশেষ করে দিতে পারি।’
সেই নির্বাচনী পন্থাটি কী হতে পারে, সে সম্পর্কে আলোকপাত করেননি গোলাম পরওয়ার। তবে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে নিঃশেষ করার জন্য নির্বাচনী পন্থা অবলম্বনে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে ঐক্যের বিষয়ে একটি ইঙ্গিত দেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে পরওয়ার বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের রাজনৈতিক দলের মধ্যে যদি ঐক্য-বিভেদ সৃষ্টি করার মতো কোনো কথা, কোনো ভূমিকা, কোনো বক্তব্য, কোনো ইশারা…সেখানে আমি বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে বলতে চাই, কোনো কোনো মিডিয়া রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যের প্রতি সুবিচার না করে তিন দিকের-চার দিকের কথাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যাতে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।’ তিনি সাংবাদিকতাকে ‘সভ্যতার ব্যারোমিটার’ বলে অভিহিত করে সংবাদ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নজর দেওয়ার অনুরোধ জানান।
‘ইসি, সার্চ কমিটি গঠনে গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়নি’
অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত, কিছু নীতি গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হচ্ছে না বলে দাবি করেন গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের সকল সিদ্ধান্ত, সকল নীতি, সকল ভূমিকা—সবকিছুর মধ্যে গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকা উচিত। কিন্তু তিন মাস অতিবাহিত হচ্ছে, এই ছাত্র-জনতার আত্মদান, আমরা লক্ষ করছি দুর্ভাগ্যজনক হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত, নীতি—সেই গণ-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলছে না।’
পরওয়ার বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দল বলছে, অবিলম্বে সংস্কারকাজ সম্পন্ন করুন এবং নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। আমরা ধন্যবাদ জানাই, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, সংবিধান, জনপ্রশাসনের সংস্কারসহ অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছে। কমিশনগুলো তাদের সংস্কার প্রস্তাব জমা দেবে এবং সেগুলোর ওপর আলোচনা হবে। এরপর একটি নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের এবং সংস্কারের পলিসি বাস্তবায়ন করবেন। …কিন্তু হঠাৎ করেই সার্চ কমিটি গঠন করা হলো। নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হলো। এখানে কি জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে?’
এ প্রসঙ্গে এই জামায়াত নেতা আরও বলেন, ‘আমরা তো মনে করেছিলাম, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য (রাজনৈতিক দল) সব অংশীজনের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হলো। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিক সমাজ—সবাই দিচ্ছেন। যেটা ডিসেম্বরের মধ্যে আসবে। সেই নির্বাচনী সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের জন্য সার্চ কমিটি গঠনের কী পদ্ধতি হবে, সেগুলোও কিন্তু ইট ইজ অলসো দ্য পার্ট অব রিফর্ম প্রপোজাল। কিন্তু সেটা আসার আগেই আপনারা একটা সার্চ কমিটি গঠন করলেন। হাজারো শহীদের রক্তে ভেজা গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রায় এটাকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই। কিন্তু আপনারা তো এই সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া সার্চ কমিটি গঠনের পদ্ধতিকে ব্যবহার করে যে সার্চ কমিটি গঠন করলেন। এতে কি গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়েছে?’
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে পরওয়ার আরও বলেন, ‘আপনারা জনগণের কাছে প্রস্তাব চাইলেন, আমরা পেশ করলাম, কিন্তু ডিসেম্বর পর্যন্ত যেতে দিলেন না। তার আগেই সিদ্ধান্ত দিলেন। এখানে তো একটা রহস্যের তৈরি হয়। এ রকম কিছু কিছু সিদ্ধান্তের জন্য…আপনি সংবিধান সংস্কারের জন্য প্রস্তাব চাইলেন। আপনি দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্য প্রস্তাব চাইলেন, আমরা ডিউ টাইমে সব দিচ্ছি। সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে বলব, আমরা যেন আর ভুল না করি। ১৫ থেকে ১৭ বছর বারবার আমরা ভুল করেছি। অনেকগুলো রাজনৈতিক নেতৃত্বে ভুল হয়েছে, নীতি-নির্ধারণে ভুল হয়েছে। আজকে হাজারো শহীদের রক্ত দানের পর জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে আপনারা দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনাদের কাছে এমন কোনো ভুল সিদ্ধান্ত, ভুল পলিসি আমরা আর দেখতে চাই না।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব শহিদ উদ্দিন চৌধুরী, মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির নূরুল ইসলামসহ সাংবাদিক নেতারা বক্তব্য দেন।