সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ তৈরির জন্য অংশীজনদের মতামত ও প্রস্তাব নেবে সংবিধান সংস্কার কমিশন। আগামী সপ্তাহ থেকে রাজনৈতিক দল বাদে অন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে তারা। তবে যেসব ব্যক্তি, সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক দল জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের সময় সক্রিয়ভাবে হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থেকেছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নকে সমর্থন করেছে, ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে সাহায্য করেছে, তাদের সংস্কার প্রস্তাবের সুপারিশ তৈরিতে যুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ কমিশন।
আজ রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ পরিকল্পনার কথা জানান। এ সময় তিনি সাংবিধানিক সংস্কারের সাতটি উদ্দেশ্যের কথা তুলে ধরেন। জাতীয় সংসদের একটি মিলনায়তনে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সংবিধান পুনর্লিখন করা হবে কি না বা কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার দরকার, তা কমিশন চিহ্নিত করেছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, তাঁরা এখন বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা করছেন। এ ক্ষেত্রে ৫২ বছর ধরে সংবিধানের যে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমালোচনা, সাংবিধানিক আলোচনা সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এর মধ্য দিয়ে চিহ্নিত করা হবে কোন কোন জায়গায় সুনির্দিষ্টভাবে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন, পুনর্লিখন প্রয়োজন। পূর্বধারণা থেকে কমিশন কিছু করছে না।
লিখিত বক্তব্যে সংস্কার কমিশনের পরিধির কথা তুলে ধরেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের লক্ষ্যে সংবিধানের সামগ্রিক সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন, পুনর্বিন্যাস এবং পুনর্লিখনের বিষয় আসবে।
এক প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, তাঁরা সব কটি বিষয় টেবিলে রাখছেন। তাঁরা জানেন না, অংশীজনেরা কী চান। অংশীজনদের কথা শোনার পর যা প্রয়োজন হবে, তা সুপারিশ করতে কমিশন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
লিখিত মতামত নেবে, তবে বসবে না দলগুলোর সঙ্গে
আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন সংস্কারের সুপারিশ তৈরির জন্য বিভিন্ন অংশীজনের মতামত ও প্রস্তাব গ্রহণ করবে। সাধারণ নাগরিকদের মতামত ও প্রস্তাব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংগ্রহ করবে। আগামী মঙ্গলবার থেকে ওয়েবসাইট কার্যকর হবে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ওয়েবসাইটের ঠিকানা জানিয়ে দেওয়া হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের লিখিত মতামত ও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠানোর অনুরোধ করা হবে বলে জানান আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, সরকার বিভিন্ন কমিশনের কাছ থেকে পাওয়া সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে। ফলে কমিশনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করবে না। কিন্তু তাদের দেওয়া প্রতিটি লিখিত প্রস্তাব ও মতামত কমিশন নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করবে এবং কমিশন তাদের সুপারিশে তার যথাসাধ্য প্রতিফলন ঘটাতে সচেষ্ট থাকবে।
আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন এ পর্যায়ে সংবিধান-বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, সিভিল সোসাইটির সংগঠনগুলোর প্রতিনিধি, সিভিল সোসাইটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, পেশাজীবী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধি, তরুণ চিন্তাবিদ, সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করবে। তাঁদের কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব আহ্বান করা হবে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা করা হবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের জন-আকাঙ্ক্ষা সম্পৃক্ত করেই তাঁরা প্রস্তাব তৈরি করবেন। এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি—এ বিষয়গুলো বিভিন্ন আলোচনায় এসেছে। তবে এসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে গেছে, তা বলা যাবে না।
বাস্তবায়ন করবে কোন সরকার
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বর্তমান সরকার বাস্তবায়ন করবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য মাহফুজ আলম বলেন, তিনি এখানে (সংবাদ সম্মেলনে) প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে আসেননি। এটি একেবারেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে তাঁকে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ধরা হলে তিনি বলতে পারেন, অবশ্যই এ সরকারই বাস্তবায়ন করবে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে, তা খোলাসা করেননি তিনি।
মাহফুজ আলম বলেন, সংবিধান বিষয়ে যে প্রশ্নটা সেটা এক দফা ঘোষণার দিনই বাতিল হয়েছে। কারণ, সেখানে বলা হয়েছিল, ‘পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আমরা খারিজ করছি, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চাই।’ নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মানেই নতুন সংবিধান।
সাত উদ্দেশ্য
সাংবিধানিক সংস্কারের সাতটি উদ্দেশ্যের কথা তুলে ধরেন কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ। সেগুলো হলো ১. দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের আলোকে বৈষম্যহীন জনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। ২. ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো। ৩. রাজনীতি এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় সর্বস্তরে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা। ৪. ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধ। ৫. রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা এবং বিচার বিভাগের পৃথক্করণ ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। ৬. রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতায়ন। ৭. রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক এবং আইন দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা।