মো. মুসা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। স্বজনেরা তাঁর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছেন। আর পাশে তাঁর স্ত্রী মিনু আক্তার আহাজারি করেই যাচ্ছেন। একটা কথাই বারবার বলছিলেন, ‘বাসায় এসে ছেলে আমায় মা বলে ডাকতে পারবে না আর।’ গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশ ঘরের সামনে এই চিত্র দেখা গেছে।
এর আগে গতকাল বিকেল সোয়া চারটার দিকে নগরের চান্দগাঁও থানার শমসের পাড়া এলাকায় মো. মুসা ও মিনু আক্তারের ছেলে আফতাব উদ্দিন তাহসিনকে (২৬) প্রকাশ্যে মাইক্রোবাসে করে এসে গুলি করে খুন করা হয়। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে এসে মা-বাবা দেখতে পান সন্তানের রক্তাক্ত লাশ। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে ছেলের ঊরু থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও পরিবার বলছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন তাঁর সহযোগীদের নিয়ে মাইক্রোবাসে করে এসে গুলি করে চলে যান। আশপাশে লোকজন থাকলেও ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি। নিহত আফতাব ইট, বালুর ব্যবসা করেন। বিদেশে পলাতক শিবির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত আরেক সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খানের সহযোগী হিসেবে এই সাজ্জাদ। অপরাধ জগতে পা রেখেই দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজির ১০টি মামলা রয়েছে। শেষ গত ১৭ জুলাই চান্দগাঁও থানা-পুলিশ অস্ত্রসহ সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করে। পরের মাসে তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। বায়েজিদ বোস্তামী থানা-সংলগ্ন হাটহাজারীর শিকারপুরের মো. জামালের ছেলে সাজ্জাদ।
নিহত আফতাব ইট, বালুর ব্যবসার করেন। তিনি শিবির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সরোয়ার হোসেনের অনুসারী ছিলেন। গতকাল সন্ধ্যায় চমেক হাসপাতালের লাশ ঘরের সামনে গিয়ে দেখা যায়, নিহত আফতাবের স্বজনেরা কান্নাকাটি করছেন। কেউ কেউ পুলিশের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তাঁদের অভিযোগ, সন্ত্রাসী সাজ্জাদকে পুলিশ ধরছে না। যার কারণে এলাকায় বেপরোয়া হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন তিনি। প্রকাশ্যে চালাচ্ছেন গুলি। যার ধারাবাহিকতায় আফতাবকেও গুলি করে খুন করা হয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. ইসতিয়াক প্রথম আলোকে বলেন, চান্দগাঁও থানার শমসের পাড়ার উদুপাড়া এলাকায় আফতাব তাঁর ব্যবসার জন্য আনা বালু ও ইট রাখেন। বিকেল সোয়া চারটার দিকে মজুতের জন্য এক ট্রাক বালু আনা হয়। এ কারণে আফতাব সেখানে আসেন। কিছুক্ষণ পর সেখানে একটি মাইক্রোবাস আসে। প্রথমে গাড়ির ভেতর থেকে আফতাবকে লক্ষ্য করে একটি গুলি ছোড়া হয়। এরপর সন্ত্রাসী সাজ্জাদ ও তাঁর সহযোগী মাহমুদ, হাছানসহ চারজন গাড়ি থেকে নেমে গুলি করতে থাকেন। তাঁরা আফতাবের ঊরু ও পায়ে পরপর চারটি গুলি করে চলে যান। আশপাশে লোকজন থাকলেও তাঁদের হাতে অস্ত্র থাকায় কেউ এগিয়ে আসেননি।
স্ত্রী মিনু আক্তারে পাশেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মুসা। ছেলের রক্তাক্ত লাশ দেখে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এলে বলতে থাকেন, ‘আমার ছেলেকে কেন মেরেছে। যারা মেরেছে তাদের ফাঁসি চাই।’
নিহত আফতাবের ছোট ভাই মো. তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসী সাজ্জাদের বিরুদ্ধে তাঁর ভাই ফেসবুকে লেখালেখি করতেন। সাজ্জাদ কথায় কথায় এলাকায় গুলি করতেন। ইট, বালুর ব্যবসা করায় ভাইয়ের কাছে চাঁদাও চেয়েছেন। এই কারণে আদালতে জিডিও করেন দুই মাস আগে।
জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আবদুল মান্নান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসী সাজ্জাদই গুলি করেছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাঁকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
তবে আফতাবের লাশ দেখতে আসা স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বজনেরা অভিযোগ করেন, কখনো চাঁদার দাবিতে, কখনো তাঁর মতের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে সাজ্জাদ প্রকাশ্যে গুলি চালান। কিন্তু পুলিশ তাঁকে ধরছে না। যার কারণে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন সাজ্জাদ। এভাবে চলতে থাকলে এলাকায় কেউ থাকতে পারবেন না।
গত দেড় মাসে প্রকাশ্যে অস্ত্রাবাজির পরপর তিনটি ঘটনা ঘটেছে বায়েজিদ বোস্তামী, পাঁচলাইশ, চাঁদগাও ও হাটহাজারীতে। এসব ঘটনার সঙ্গে সাজ্জাদ জড়িত বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন জানান। সর্বশেষ সোমবার দিনদুপুরে প্রকাশ্য আফতাবকে গুলি করে খুনের পর সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যাওয়ায় লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সন্ত্রাসী সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার না করায় ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
এ ঘটনায় আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টা পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হননি, হয়নি কোনো মামলাও। তবে নিহত আফতাবের স্বজনেরা থানায় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান।