সকাল থেকেই হাসিখুশি ভাব তরুণটির। সাত দিন ধরে কৃত্রিম পায়ে হাঁটছেন তিনি। বলা যায়, হাঁটার চেষ্টা বা চর্চা করছেন। তিনি হেঁটে দেখছেন ও চিকিৎসকেরা তাঁর হাঁটা দেখছেন—সব ঠিকঠাক আছে কি না। এখন তাঁর বাড়ি ফেরার পালা। আজ বা কাল তাঁকে ছুটি দেওয়া হবে।
১৯ বছর বয়সী এই তরুণের নাম মোহাম্মদ আকাশ মিয়া। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার পর তাঁর বাঁ পা কেটে ফেলা হয়। ব্র্যাক তাঁকে কৃত্রিম পা দিয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভাবিনি এমন হতে পারে।’
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ব্র্যাক কৃত্রিম পা সংযোজন ও চিকিৎসাকেন্দ্রে দেখা হয় আকাশ মিয়ার সঙ্গে। তাঁর বাঁ পাটি সিনেমা বা ছবিতে দেখা রোবটের পায়ের মতো। সিঁড়ি ভাঙলেন, হাঁটলেন, পাশে বসলেন, মুখে হাসি। ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রধান শাহিনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওর ছুটির প্রস্তুতি চলছে, তাই চেহারাটা আজ ভালো দেখা যাচ্ছে।’
ব্র্যাকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০ জনের একটি করে পা কেটে ফেলা হয়েছে। বাকি ৭ জনের একটি করে হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। এই ২৭ জনকে পর্যায়ক্রমে মোহাম্মদপুরের এই কেন্দ্রে এনে কৃত্রিম হাত বা পা সংযোজন করবে ব্র্যাক।
আকাশ মিয়া বলেন, বাড়ি তাঁর নেত্রকোনার মদন উপজেলায়। কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের চিটাগং রোডের বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারে। ২০ জুলাই মিষ্টির দোকানে ঢুকে পুলিশ খুব কাছ থেকে শটগান দিয়ে তাঁকে গুলি করে। রাস্তায় আন্দোলনে থাকা ছাত্রদের কয়েকজন তাঁকে প্রথমে কাঁচপুর এলাকার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নেন, সেখান থেকে মোহাম্মদপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে।
আহত থাকা অবস্থায় আকাশকে ২০ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত একাধিক হাসপাতালে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ট্রমা সেন্টার, পঙ্গু হাসপাতাল, হৃদরোগ হাসপাতাল এবং সর্বশেষ ২২ জুলাই আবার পঙ্গু হাসপাতাল। পঙ্গু হাসপাতালেই ২৩ জুলাই অস্ত্রোপচার করে তাঁর বাঁ পা কেটে ফেলা হয়। তাঁর পা পুরোপুরি সেরে ওঠার আগেই ১ আগস্ট তাঁকে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়।
দৌড়াতে পারব না, এটাই দুঃখ। ভারী কাজ করা নিষেধ। আগে যে কাজ করতাম, সে কাজ কারতে পারব। অন্য কাজও করতে পারব
আকাশ মিয়া
ব্র্যাকের কর্মকর্তারা বলেন, পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় ব্র্যাকের পক্ষ থেকে তাঁর মতো আরও অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সেই যোগাযোগের সূত্র ধরেই মোহাম্মদপুরের এই কেন্দ্রে তিনি আসেন ২ সেপ্টেম্বর।
এই কেন্দ্রে এসে তাঁর পায়ের মাপজোক করা হয় কৃত্রিম পা ঠিকঠাক লাগানোর জন্য। পাশাপাশি পায়ের মাংসপেশির শক্তি বাড়ানোর চিকিৎসা চালান ফিজিওথেরাপিস্টরা। এরপর একদিন কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ান। তারপর সাত দিন ধরে চিকিৎসকদের নির্দেশ ও পরামর্শমতো কৃত্রিম পায়ে হাঁটছেন, চলছেন।
আকাশ মিয়া বলেন, ‘দৌড়াতে পারব না, এটাই দুঃখ। ভারী কাজ করা নিষেধ। আগে যে কাজ করতাম, সে কাজ কারতে পারব। অন্য কাজও করতে পারব।’
ওরা ২৭ জনের ৮ জন
ব্র্যাকের ওই কেন্দ্রে কৃত্রিম পা লাগানোর জন্য বর্তমানে আটজন ভর্তি আছেন। তাঁদের মধ্যে আকাশ মিয়ার মতো আছেন তিনজন। তাঁরা বাড়ি যাওয়ার অবস্থায় আছেন। দুজন হাঁটার চর্চা করছেন। আর তিনজন দু-এক দিন আগে এসেছেন। তাঁদের পায়ের মাপজোক শেষে গতকাল প্রথম কৃত্রিম পায়ের ওপর দাঁড়িয়েছেন।
ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রধান শাহিনুল হক বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গুরুতর আহত মোট ২৭ জন হাত বা পা হারিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে ব্র্যাকের যোগাযোগ আছে। তাঁদের প্রত্যেককে ব্র্যাক কৃত্রিম হাত বা পা দেবে। একটি কৃত্রিম পায়ের দাম ৩ থেকে ৮ লাখ টাকা। আর কৃত্রিম হাতের দাম সাড়ে ৩ লাখ টাকা।
ব্র্যাকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০ জনের একটি করে পা কেটে ফেলা হয়েছে। বাকি ৭ জনের একটি করে হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। এই ২৭ জনকে পর্যায়ক্রমে মোহাম্মদপুরের এই কেন্দ্রে এনে কৃত্রিম হাত বা পা সংযোজন করবে ব্র্যাক।
খুব ভালো লাগতেছে। মনে হচ্ছে হাঁটতে পারব, আবার গাড়ি চালাতে পারব।
রাজু মিয়া
গতকাল ওই কেন্দ্র থেকে চলে আসার আগে কথা হয় মোহাম্মদ রাজু মিয়ার সঙ্গে। গাজীপুরের এরশাদনগরে ১ নম্বর ব্লকে থাকেন। অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন ৩০ বছর বয়সী এই যুবক। ২০ জুলাই তামীরুল মিল্লাত মাদ্রাসার সামনে আহত এক ছাত্রকে অটোরিকশায় তুলতে গিয়ে নিজেই ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।
রাজুকে প্রথমে এলাকার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। ক্লিনিকে তাঁকে শুধু পায়ে ব্যান্ডেজ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। রাতে তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে, পরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। চার দিন পর সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়। পায়ে পচন ধরলে পঙ্গু হাসপাতালে ২৭ জুলাই তাঁর পা কেটে ফেলা হয়। ২ আগস্ট পঙ্গু হাসপাতাল তাঁকে ছুটি দেয়।
রাজু মিয়া ব্র্যাকের এই কেন্দ্রে এসেছেন ২৯ আগস্ট। পায়ের ক্ষতস্থান শুকাতে সময় লেগেছে। গতকাল প্রথম কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘খুব ভালো লাগতেছে। মনে হচ্ছে হাঁটতে পারব, আবার গাড়ি চালাতে পারব।’