দ্যা নিউ ভিশন

নভেম্বর ২৫, ২০২৪ ০৯:৫০

বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি নির্মাণ নিয়ে চিন্তায় বন্যার্তরা

বসতঘরটি বন্যার পানিতে ধসে পড়ে আছে। ঘরে যা ছিল সব নষ্ট হয়ে গেছে। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া গ্রামের ফয়েজ আহমেদের চিন্তা কীভাবে নতুন করে ঘর মেরামত করবেন। গত বুধবার দুপুরে।

বন্যার পানি বাড়ায় কাছের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) কার্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের নরোত্তমপুর গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (৫০)। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে সেখানে অনেক কষ্টে পাঁচ দিন ছিলেন। এরপর বাড়ি ফিরে দেখেন, বসতঘরটি বন্যার পানিতে ধসে পড়ে আছে। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় তেমন কিছুই সঙ্গে নিতে পারেননি। ঘরে যা ছিল সব নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরের ভিটি থেকে মাটি সরে গেছে। পুরোটাই এখন থকথকে কাদায় ভরা। ঘরের সামনে এখনো প্রায় কোমরসমান পানি। বাধ্য হয়ে স্ত্রী-সন্তানকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেখানে পানি কিছুটা কম।

নোয়াখালীর আনোয়ার হোসেনের মতো চার জেলার কয়েক লাখ পরিবারের ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় বেশি ক্ষতি হয়েছে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুর জেলার। এসব জেলায় এ পর্যন্ত ৩ লাখ ২০ হাজার ৪৬০টি ঘরবাড়ি আংশিক ও সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা গেছে।

ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢল ও প্রবল বর্ষণে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় ১১ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। গত ২০ আগস্ট রাত থেকে আকস্মিক বন্যায় এ পর্যন্ত ৭১ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এবারের বন্যায় ফেনী জেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে; কিন্তু বাড়িঘর বিধ্বস্ত হওয়ায় এখনো অনেকে নিজের বসতভিটায় ফিরতে পারছেন না। কারও বসতঘর আংশিক, কারোর সম্পূর্ণ ধসে গেছে। বন্যার্তরা এখন কীভাবে ঘরবাড়ি তুলবেন তা নিয়ে চিন্তিত।

ফেনীতে বন্যায় ৬৪ হাজার ৪১৫টি বসতঘর আংশিক ও সম্পূর্ণ ধসে গেছে। ফুলগাজী উপজেলার জিএম হাট ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে হরিমোহন সরকারের (৭০) ২৪ হাত দীর্ঘ ও ১৪ হাত প্রস্থের মাটির ঘরটি গত ২৩ আগস্ট সম্পূর্ণ ধসে গিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তিনি প্রায় ৩০ বছর আগে ঘরটি তৈরি করেছিলেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কথা হয় হরিমোহনের সঙ্গে। কথা বলতে বলতে একসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি জানান, ঘরটা আবার নতুন করে দাঁড় করানোর মতো আর্থিক সংগতি নেই তাঁর।

ফেনীর জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার জানান, প্রাথমিকভাবে একটি জরিপ করা হয়েছে। সেই জরিপের ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সরকার ঢেউটিন বরাদ্দ দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার কথা ভাবছেন।

নোয়াখালীতে বন্যায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৫টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় প্রাথমিকভাবে জেলার আটটি উপজেলায় ৮ হাজার ৪৫৩টি বসতঘর সম্পূর্ণ এবং ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৭২টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বন্যায় ঘর ছেড়ে সেনবাগ উপজেলার কাদরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিলেন উত্তর কাদরার বাসিন্দা শাহিদা আক্তার। বাড়ি ফিরে দেখেন, একচালার বসতঘরটি খানিক হেলে পড়েছে। ভিটা থেকে মাটি সরে গেছে। ভেতরে পা দেওয়ার অবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে প্রতিবেশী এক ব্যক্তির বাড়িতে উঠেছেন তিন সন্তানকে নিয়ে। শাহিদার স্বামী রিকশাচালক। যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাতেই ক্লান্ত তিনি। এখন কীভাবে ঘর মেরামত করবেন, সে চিন্তায় ঘুম নেই তাঁর।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. জাহিদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, জেলার অনেক এলাকা থেকে এখনো বন্যার পানি নামেনি। বন্যার পানি এখানে স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে।

ভেঙে যাওয়া বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করছিলেন ফয়েজ আহমেদ (৪৫)। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। গত ২৩ আগস্ট রাতে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় শত শত বাড়িঘর। এসব বাড়িঘরের মধ্যে রয়েছে ফয়েজের বসতঘর। তিনি কৃষিকাজ করে সংসার চালান। তাঁর আয়ের আর কোনো পথ নেই।

ফয়েজ বলেন, ‘বাড়ি কেমনে বানায়াম জানি না। সরকার যদি সাহাইয্য না করে, আমি আমার দুইডা পোলা আর বউডারে লইয়া ক্যামনে থাইক্কাম, কই যায়াম? কয়দিন ধইরা মাইনষে খানা দেয়। এডি খাইয়া রইছি।’

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবেদ আলী জানান, এখন কুমিল্লার বুড়িচংসহ বন্যাকবলিত ১৪টি উপজেলার যেসব ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর প্রাথমিক হিসাব করা হয়েছে। যার মধ্যে ৮ হাজার ৬৭৪টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৪ হাজার ৮১টি ঘরবাড়ি। এই তালিকা ঢাকায় পাঠানো হবে।

লক্ষ্মীপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার পাঁচটি উপজেলা ও চারটি পৌরসভায় ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘরের সংখ্যা ১৮ হাজার ৩৬৫টি। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশই কাঁচাঘর। অন্যগুলো আধা পাকা ও পাকা বসতঘর।

রামগতি সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া বকুল বেগম বলেন, বন্যায় তাঁর সব শেষ। বসতঘরটি হেলে পড়েছে। যেকোনো সময় ধসে পড়বে। কৃষিকাজ করেই সংসার চলে। স্বামী, তিন ছেলে, দুই মেয়েসহ নয়জনের সংসার। টেনেটুনে সংসার চালান। এখন আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন পরিবার নিয়ে। ঘর কীভাবে বানাবেন—এই চিন্তায় দিশেহারা তিনি।

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ

ঝলমলে আইপিএল নিলামের অন্য রূপ: কালো তালিকা, রাতারাতি কোটিপতি আর ক্ষমতা প্রদর্শন

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ললিত মোদি। ভারতীয় ক্রিকেট