দ্যা নিউ ভিশন

ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৫ ০২:০৪

সংস্কার চাপিয়ে দেবে না সরকার: প্রধান উপদেষ্টা

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বক্তব্য দেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস

অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কারের প্রস্তাব চাপিয়ে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুপারিশ আনা হয়েছে। এই সরকার শুধু বোঝাবে, এসব সংস্কার কেন প্রয়োজন ও কীভাবে তা করা যায়। বাকি কাজটা করবে রাজনৈতিক দলগুলো।

গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এ কথাগুলো বলেন।

রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সংস্কারটা যেন এমনভাবে হয়, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা তাঁদের অবস্থান থেকে ভালো কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এখান থেকে কতটুকু গ্রহণ করব, কীভাবে অগ্রসর হব, এর জন্য আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করা। কোনটা কাজে লাগাতে পারব, কোনটা গ্রহণ করব। আপনারা জনগণের প্রতিনিধি, তাই আপনাদের সঙ্গে এ নিয়ে বাস্তবভিত্তিক আলোচনা হতে হবে। এমন মজবুতভাবে আইনকানুন করব, যাতে সবাই মেনে চলে ও এর মাধ্যমে একটা সুন্দর সমাজ তৈরি করা যায়।’

সংস্কার প্রস্তাব চাপিয়ে দেওয়া হবে না মন্তব্য করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে সুপারিশগুলো নিয়ে এসেছি। (এসব সুপারিশ) চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা শুধু বোঝাব, কেন সংস্কার প্রয়োজন এবং কীভাবে সংস্কার করা যায়। বাকিটা আপনাদের কাজ।

একটু রদবদল করলে দেখবেন সুন্দর হয়ে যাবে। আমরা কেবল সাচিবিক কাজ করে দেব।’

দীর্ঘ মেয়াদে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের আইনি কাঠামো তৈরির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারপ্রক্রিয়া সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সংস্কার যদি আমরা সঠিকভাবে করতে পারি, তাহলে বাঙালি জাতি হিসেবে যত দিন টিকে থাকবে, তত দিন আপনাদের অবদান থেকে যাবে।’

‘সংস্কার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই’

সংস্কার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মহল আমাদের বলে, তোমাদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করতে পারি, কিন্তু সংস্কারটা তোমাদের করতে হবে। আন্তর্জাতিক সমর্থন, সহযোগিতা এবং তাদের শুভেচ্ছা আমাদের জন্য মস্ত বড় সম্পদ। আমরা তাদের বহু রকমের স্বপ্নের কথা বলেছি। তারাও বলেছে, তোমরা করতে পারলে আমাদের সমস্যা নেই। কোনো কোনো শক্তিশালী দেশ বিশেষভাবে সহায়তা করতে চায়। তাই বলছি, সংস্কার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যর্থ হতে চাই না।’

রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার সুযোগ পেয়েছিল, সেই কাঠামো থেকে যেন আমরা অন্য রূপে বেরিয়ে আসতে পারি। হাডুডু খেলার ক্ষেত্রে আইন মেনে চললেও দেশটাকে একটা তামাশায় পরিণত করা হয়েছিল। আইন বলে কিছু ছিল না, নিয়ম বলে কিছু ছিল না। জুলাই বিপ্লবে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাঁরা নির্দেশ দিয়ে গেছেন, আমরা যেন সেই আইনকানুন ফেলে দিয়ে নতুন বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত হই।’

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে আমরা যদি আমাদের ঐক্যকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে তা বংশপরম্পরায় চলতে থাকবে।’ মসৃণভাবে সংলাপ চালিয়ে নেওয়ার জন্য এ সময় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

এক লন্ডভন্ড অবস্থার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই ছয় মাসের অভিজ্ঞতা হলো, দল–মতনির্বিশেষে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক ব্যক্তি সবাই অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করেছে। আমাদের মধ্যে অনেক তর্কবিতর্ক আছে, তবে আমাদের মধ্যে ঐক্য আছে এবং এটি বজায় থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।’

অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় পর্ব শুরু

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই সংলাপের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো বলে মনে করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আজ আমাদের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে। আপনারা দ্বিতীয় পর্বের স্রষ্টা। আপনারা সংস্কার সুপারিশগুলো জাতির সামনে নিয়ে আসবেন। আপনাদের সহযোগিতা করার জন্য কমিশনের সদস্যরা নিয়োজিত থাকবেন। আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করুন, যেন আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজে নেমে পড়তে পারি। নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হবে, কেউ যেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে।’

সরকারের প্রথম পর্বে (ছয় মাস) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘প্রথম পর্বের একটা অভিজ্ঞতা হলো, সরকার দেশের জনগণের ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন দুটোই পেয়েছে। পৃথিবীজুড়ে আমাদের প্রতি বড় রকমের সমর্থন গড়ে উঠেছে। যে কারণে অপর পক্ষ (ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী সরকার) সুবিধা করতে পারছে না, বহু গল্প করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনো গল্প টেকাতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে গিয়ে গল্প চালাতে পারল না।’

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে অপপ্রচার থেমেছে

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের দেশের মানুষের ওপর চালানো নির্মম নির্যাতন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে ঘিরে যে অপপ্রচার চলছিল, এই প্রতিবেদন তা বন্ধ করে দিয়েছে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এখন কারও বানানো বয়ান কেউ শুনবে না, ওইটা চূড়ান্ত। আর কত সমর্থন চাই আমরা, একেবারে অক্ষরে অক্ষরে তারা বলে দিয়েছে কাকে কোথায় মারা হয়েছে। এর থেকে বের হওয়ার তো কারও উপায় নেই।’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ছয় মাস সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যারা আমাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছি। আমাদের শক্ত থাকতে হবে, মজবুত থাকতে হবে। একত্রে থাকতে হবে।’

চূড়ান্ত লক্ষ্য জুলাই সনদ তৈরি করা

সমাপনী বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে একটা সনদ তৈরি করা। সেটাই হবে জুলাই সনদ। সনদ তৈরির পর বাস্তবায়নের পথ বের হয়ে যাবে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সংস্কারটা গভীরভাবে হতে হবে। আপনারা বলবেন আমাদের প্রস্তাবে আপনারা একমত; অথবা কোন প্রস্তাবের সংশোধনী চান বা কোন কোন প্রস্তাবে একমত হলেন না। যাতে করে একটা জুলাই সনদ তৈরি করা যায়। সবাই মিলে একমত হয়ে গেলে বাস্তবায়নের পথ বের হয়ে যাবে।’

জুলাই সনদ তৈরি করা ছাড়া মুক্তি নেই উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সংলাপের মাধ্যমে বের হয়ে আসবে প্রস্তাবের পেছনে এতগুলো দল একমত। পরে সনদ যখন হয়ে যাবে, তখন সেটা প্রকাশ করা হবে। যাতে মানুষ জানতে পারে কোন রাজনৈতিক দল কতগুলো প্রস্তাবে একমত হয়েছে।

জুলাই সনদের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচন

জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, তা জুলাই সনদের ওপর নির্ভর করছে বলে জানিয়েছেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, ‘জুলাই সনদের ওপর নির্ভর করবে আমাদের নির্বাচনটা কবে হবে।’

গতকাল বেলা তিনটায় ফরেন সার্ভিস একাডেমির সামনে সাংবাদিকদের এ কথা জানান প্রেস সচিব। শফিকুল আলম বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে বলে ইতিমধ্যে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সে ক্ষেত্রে আমরা হয়তো কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারব। আর পরে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তারা বাকিগুলো বাস্তবায়ন করবে।’

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ