দৌলত উজির বাহ্রাম খাঁর ‘লাইলি মজনু’ ছিল বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত প্রথম বই। আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, লোকসংস্কৃতি নিয়েও গ্রন্থ প্রকাশ করেছে তারা। প্রতিষ্ঠানটিতে আছে দুষ্প্রাপ্য পুঁথি ও বইয়ের সংগ্রহ। বিভিন্ন অভিধান প্রকাশে আছে একাডেমির বিশেষ অবদান। কিন্তু দুই দশক ধরে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা, প্রকাশনা ও পুনর্মুদ্রণকাজ নিয়ে উঠে আসছে সমালোচনা। ৬৯ বছর বয়সী এ প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্ব বাংলা ভাষার উৎকর্ষসাধনে কাজ করা।
মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা আর বছরব্যাপী শতাধিক অনুষ্ঠান আয়োজনে গুরুত্বহীন হয়েছে একাডেমির গবেষণাকাজ। প্রতিষ্ঠানের গত আট বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বছরজুড়ে আয়োজন করা অনুষ্ঠানের অধিকাংশই ‘স্মরণ’ ও ‘দিবস পালনে’ সীমাবদ্ধ। অথচ গবেষণামূলক প্রবন্ধ, নিবন্ধ উপস্থাপনে নেই আগ্রহ। একাডেমির বাজেট বরাদ্দেও সে প্রভাব স্পষ্ট। চলতি বছরের বাজেটে গবেষণার চেয়ে অনুষ্ঠানের বরাদ্দ ছিল ৪ গুণ।
এদিকে ১৫ বছর ধরে বাংলা একাডেমি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লেখা বই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও গুরুত্ব পেয়েছে এই একই প্রসঙ্গ।
বরাদ্দেও নেই, কাজেও নেই ‘গবেষণা’
গবেষণা ও অনুবাদ শাখা নিয়ে ১৯৫৫ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলা একাডেমির। বাংলা ভাষা নিয়ে সবচেয়ে বড় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এটি।
একাডেমির চলতি বছরের প্রকাশনার তালিকা থেকে দেখা যায়, এটির ‘প্রবন্ধ-সংকলন, সাহিত্য গবেষণা ও সমালোচনা বিভাগ’ থেকে গত ১৫ বছরে প্রকাশিত হয়েছে ৪৪টি বই। এর মধ্যে ১৯টি পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। পাঁচটি বই জেলা সাহিত্য মেলা নিয়ে। অর্থাৎ ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একাডেমি নিজস্ব গবেষণামূলক বই প্রকাশ করেছে মাত্র ২০টি।
—প্রতিষ্ঠানের গত ৮ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বছরজুড়ে আয়োজন করা অনুষ্ঠানের অধিকাংশই ‘স্মরণ’ ও ‘দিবস পালনে’ সীমাবদ্ধ।
প্রতিষ্ঠানের বাজেট বণ্টনেও পাওয়া যায় গবেষণা খাতে কম গুরুত্বের চিত্র। একাডেমির হিসাব বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ৪০ কোটি ২১ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকাশনার জন্য বরাদ্দ ১ কোটি ৫ লাখ টাকা, অনুষ্ঠান আয়োজনে ১ কোটি ৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও গবেষণায় ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ মোট বাজেটের ২ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রকাশনা ও ২ দশমিক ৬০ শতাংশ অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ। বিপরীতে গবেষণার জন্য বরাদ্দ মাত্র দশমিক ৬৩ শতাংশ।
জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলা একাডেমি নিয়ে মানুষের যে প্রত্যাশা, তা বাংলা একাডেমির কাজের মধ্যেই পড়ে। অতিরিক্ত চাওয়া না। তবে সবই যে যৌক্তিক, তা-ও নয়। প্রকাশিত বইয়ের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ গবেষণাবিষয়ক বই।’ প্রকাশিত বইগুলো কেন গবেষণাবিষয়ক হিসেবে ধরা হবে না, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
—বাংলা একাডেমি থেকে একটি পুরস্কার দেওয়া হয় পল্লিকবি জসিমউদ্দীনের নামে। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রকাশিত হয়নি ‘জসিমউদ্দীন রচনাবলী’।
ষাটের দশকে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সম্পাদনায় যে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকাশিত হয়েছিল, এটির আর পরিমার্জন করা হয়নি। এমনকি বর্তমান সংস্করণের প্রিন্ট ঝাপসা বলেও অভিযোগ আছে অনেক পাঠকের। গুরুত্বপূর্ণ রচনাবলি ও জীবনী প্রকাশ করা নিয়ে একাডেমি কী ভাবছে, জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, ‘নতুনভাবে করা মানে নতুন জরিপ, প্রচুর মানুষকে সম্পৃক্ত করা। বড় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছাড়া এটা (আঞ্চলিক ভাষার অভিধান) বাংলা একাডেমির পক্ষে প্রাথমিকভাবে কঠিন। চূড়ান্তভাবে এর দায়িত্বে সম্পাদক হিসেবে থাকতে হবে একজনকে। আঞ্চলিক ভাষার অভিধানের মতো খুবই বিশেষায়িত ব্যাপারে যে পাণ্ডিত্য, প্রজ্ঞা, দায়িত্ব নিয়ে লেগে থাকার অভ্যাস প্রয়োজন, তেমন মানুষই এখন কম।’
মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘জীবনী সিরিজ আর ভাষাশহীদ গ্রন্থমালার খুব চাহিদা আছে। আশা করছি, শুরু করতে পারব। তবে এখনো পরিকল্পনার মধ্যে ঢুকতে পারিনি।’
এক বিষয়ে বই, আয়োজন অনেক
২০২৩ সালে বাংলা একাডেমি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বই প্রকাশ করেছে ২৬টি। বিপরীতে ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষাবিষয়ক বই মাত্র তিনটি। আর শেখ মুজিবের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে ‘শতগ্রন্থমালা প্রকাশ’ শীর্ষক কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৩ বছরে প্রকাশ করা হয় ৯৭টি বই। এর পুরো খরচ বহন করা হয় একাডেমির নিজস্ব তহবিল থেকে।
গত ১৫ থেকে ১৬ বছরে একাডেমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া কোনো বিষয়ে কাজ হয়নি। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের কাছে ছিল ‘ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ রচনাবলি’র অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন একটা ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছিল, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সুফি, ইসলামি স্কলার। তাঁর কাজ নিয়ে একাডেমির এত দায়িত্ব নেওয়ার কিছু নেই।
আবার ২০২১–২২ অর্থবছরে ‘হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু’ নামে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন করে একাডেমি। সেখানে রাখা হয় শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখা ৪১৭টি বই, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা ১৯টি ও শেখ মুজিবের পরিবারকে নিয়ে লেখা ৬২টি বই। তবে দীর্ঘদিন ধরে বাজারে ছিল না বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা ‘ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ রচনাবলী’। এ ছাড়া প্রকাশিত হয়নি এ বইয়ের চতুর্থ ও পঞ্চম খণ্ড।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র নাতনি শান্তা মারিয়া প্রথম আলোকে জানান, গত শতকের নব্বইয়ের দশকে তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে বাংলা একাডেমির কাছে ওই বিষয়ে পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়া হয়েছিল।
শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখা বইয়ের আলোচনা সভাই ১০টি
গুরুত্বপূর্ণ কাজে একাডেমির গাফিলতি থাকলেও অনুষ্ঠানের কমতি ছিল না। ২০২২–২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলা একাডেমি বইমেলা বাদ দিয়েও নিজস্ব অনুষ্ঠানই করেছে বছরজুড়ে ৮৭টি। এর মধ্যে শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখা বইয়ের ওপর আলোচনা সভা হয়েছে ১০টি। বিভিন্ন দিবস পালন আর স্মরণ অনুষ্ঠান ছাড়াও ছিল অন্যান্য অনুষ্ঠান।
‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু’ উপলক্ষেও প্রতিষ্ঠানটিতে আয়োজন করা হয়েছে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ২০২২ সালের ৫ জুলাই সকালে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে করা হয় এ আয়োজন। গত ৮ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকেও পাওয়া যায় বছরজুড়ে প্রতিষ্ঠানটির গড়ে প্রায় ১০০ অনুষ্ঠান আয়োজন করার তথ্য।
এত অনুষ্ঠান আয়োজন করলেও একাডেমির যা মূল কাজ, সেখানেই কিন্তু দুর্বল প্রতিষ্ঠানটি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাডেমির একজন পরিচালক বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্মরণ বা তাঁদের জন্ম–মৃত্যুবার্ষিকী পালন করার দায়িত্ব আছে। তাই বলে গণহারে এ রকম অনুষ্ঠান করে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে মনোযোগ নষ্ট করা জাতির সঙ্গে প্রবঞ্চনা; যদিও অনেক ভালো কাজ করার সক্ষমতা একাডেমির রয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ জীবনী ও রচনাবলি প্রকাশের দায়িত্ব রয়েছে প্রতিষ্ঠানের।’
জীবনী ও রচনাবলি প্রকাশের সংকট
বাংলা একাডেমি থেকে একটি পুরস্কার দেওয়া হয় পল্লিকবি জসিমউদ্দীনের নামে। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রকাশিত হয়নি ‘জসিমউদ্দীন রচনাবলী’। এ বিষয়ে কবির পরিবারের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে একাডেমি কর্তৃপক্ষ।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একাডেমি থেকে মোট ১৫৬টি জীবনী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তবে স্থান পায়নি সরদার ফজলুল করিম, জাহানারা ইমামের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য ব্যক্তির জীবনী।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শওকত ওসমান, শওকত আলী, কবির চৌধুরী, রিজিয়া রহমান অথবা হুমায়ুন আজাদের মতো নামকরা লেখকদের রচনাবলিও প্রকাশ করতে পারেনি একাডেমি। তবে এর সবকিছু ছাপিয়ে যায় ‘ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ রচনাবলী’ প্রকাশ করা নিয়ে একাডেমির দীর্ঘদিনের অবহেলা। দীর্ঘদিন পাওয়া যায়নি প্রকাশিত রচনাবলির তিনটি খণ্ড। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড সম্পাদনা করেছিলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনা করেন আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ। এ নিয়ে আলোচনা–সমালোচনার পর পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে প্রথম খণ্ড। চতুর্থ ও পঞ্চম খণ্ড প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সম্প্রতি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির গবেষণা বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ হারুন রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ১৫ থেকে ১৬ বছরে একাডেমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া কোনো বিষয়ে কাজ হয়নি। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের কাছে ছিল “ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ রচনাবলী”র অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন একটা ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছিল, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সুফি, ইসলামি স্কলার। তাঁর কাজ নিয়ে একাডেমির এত দায়িত্ব নেওয়ার কিছু নেই।’