বিএনপি এখন অন্তর্বর্তী সরকার, জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব—এই তিন পক্ষের সঙ্গে কোনো ধরনের ‘বিরোধ’ বা ‘বিবাদে’ জড়াতে চাইছে না। এই কৌশলটি দলের ভবিষ্যৎ নির্বাচনী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নেওয়া হয়েছে।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমনই হোক, নির্বাচনী পথে চলতে হলে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গেই কিছুটা সম্পর্ক রেখে এগোতে হবে। সেজন্য তারা সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ বজায় রাখার কৌশল অবলম্বন করবে, তবে এখনই সরাসরি বিরোধিতা বা সংঘর্ষে জড়াবে না। জামায়াতের সঙ্গে বিরোধ না করার ক্ষেত্রেও তাদের কৌশল একই, কারণ নির্বাচনের আগে কোনও ধরনের অস্থিরতা তারা চান না।
এদিকে, বিএনপি আগামী বছরের শুরুতেই মাঠে আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা করছে। তারা প্রথমে রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা প্রস্তাব জনগণের কাছে পৌঁছাতে চায় এবং এর জন্য ১০টি বিভাগীয় শহরে দলীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করবে। এসব কর্মশালায় ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের পুস্তিকা বিতরণ করা হবে এবং মাঠপর্যায়ের নেতারা সারা দেশে গণসংযোগ করবেন। এরপর, মার্চ-এপ্রিল নাগাদ নির্বাচনের জন্য দাবি জানিয়ে বৃহত্তর কর্মসূচি গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে দলের।
বিএনপির নেতা-নেত্রীরা জানান, তাদের মূল লক্ষ্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করা। এ বিষয়ে বিএনপির নেতারা প্রতিদিন আলোচনা করছেন। ৮ নভেম্বর ঢাকায় যে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নির্বাচনের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাদের তাগিদ দেওয়া। শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল নয়াপল্টন থেকে এবং জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়েছিল।
তবে দলের শীর্ষ নেতারা নির্বাচনের জন্য নানা প্রতিবন্ধকতা দেখছেন। তাদের আশঙ্কা, অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ সময় শাসনক্ষমতায় থাকতে পারে এবং এই পরিস্থিতিতে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা, বিশেষ করে জামায়াতের সম্ভাব্য তৎপরতা, বিএনপির জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে।
বিএনপির একটি অংশ মনে করে, ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। তারা আর বিএনপির অনুসারী না হয়ে, ক্ষমতার প্রতি তাদের নিজস্ব লক্ষ্য স্থির করেছে। জামায়াতের নেতারা এখন নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছেন এবং ক্ষমতায় আসার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন। এই পরিবর্তন বিএনপিকে কৌশলী হওয়ার জন্য বাধ্য করছে।
তবে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এক সাক্ষাৎকারে বলেন, দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে মৌলিক বিষয়গুলোতে ঐকমত্য থাকা জরুরি। তিনি উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক বিভাজন দেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু মতবিরোধ রয়েছে। যেমন, সংবিধানের সংস্কার, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এবং সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের প্রশ্নে জামায়াতের অবস্থান বিএনপির বিপরীতে। জামায়াত সংবিধান সংস্কারের পক্ষে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে। তবে নির্বাচনের ব্যাপারে জামায়াত ততটা আগ্রহী নয়, কারণ তারা মনে করে নির্বাচনে বিএনপির জয় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। জামায়াত বিশেষভাবে সংস্কারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়, যাতে পরবর্তীতে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা পুনরায় ফিরে না আসে।
এদিকে, বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, জামায়াতের সঙ্গে বিরোধ বৃদ্ধির বিষয়ে তারা সতর্ক রয়েছেন। তারা চান না যে নির্বাচন বা জাতীয় ঐকমত্যের প্রশ্নে কোনোরকম দূরত্ব তৈরি হোক। এজন্য বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, দলটি জামায়াতের সাথে বিরোধে জড়ানোর কোনো পরিকল্পনা করেনি। তিনি আরও বলেন, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে আওয়ামী লীগের বাইরে সব দলকে এক হতে হবে এবং কিছু বিষয়ে ঐকমত্য প্রয়োজন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, সরকারকে সময় দিতে হবে, তবে অনেক বিষয়ে সংস্কারের দরকার নেই, সেটা নির্বাচিত সংসদ করবে। তিনি আরও বলেন, দেশের মৌলিক বিষয়গুলোতে জাতীয় ঐকমত্য থাকা দরকার, যাতে দেশ সংকটে না পড়ছে।
বিএনপি শীর্ষ নেতারা বলেন, তারা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ আশা করেন। যদি তেমন কিছু না পাওয়া যায়, তাহলে আগামী মার্চ-এপ্রিল নাগাদ তারা বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করবে।