দ্যা নিউ ভিশন

নভেম্বর ২৫, ২০২৪ ০১:৫৫

শরতের সৌন্দর্য শাপলার রাজ্য সাতলায়

বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নের সাতলা বিল বাংলাদেশের একটি অনন্য পর্যটন কেন্দ্র, যা হাজারো লাল শাপলার সৌন্দর্যে সজ্জিত। এই বিলটি প্রতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শাপলার স্বর্গরাজ্যে রূপান্তরিত হয়। ভোরের সূর্যোদয়ের আলো যখন শাপলার পাপড়িতে পড়ে, তখন পুরো বিল যেন এক স্বপ্নপুরীতে পরিণত হয়। ওই সময় নৌকায় করে বিলের গভীরে গিয়ে লাল, সাদা এবং বেগুনি শাপলার মোহনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বিলের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে থাকা লাল শাপলা যেন প্রকৃতির এক চিত্রকলা। বর্ষার পানি বাড়লে শাপলার মেলা শুরু হয়, ফলে দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকেরা এই মুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে সাতলা বিলের দিকে আসেন। বিলের মাঝখানে নৌকায় ভ্রমণ করা যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনি শান্ত পানির উপরিভাগে ভাসমান শাপলার পাপড়ির লাল ছোঁয়া মনে প্রশান্তি এনে দেয়।

 

**স্থানীয়দের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি**

সাতলা বিলের আশেপাশের গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রা বিলে ওঠা-নামার সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। বর্ষাকালে বিলের পানি বেড়ে গেলে নৌকা হয়ে ওঠে তাঁদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। গ্রামবাসীরা বিলে মাছ ধরে, শাপলা সংগ্রহ করে এবং জলজ সম্পদের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই অঞ্চলের মানুষ সরল ও বন্ধুসুলভ, যারা অতিথিদের আন্তরিকতায় আপ্যায়ন করে। তাঁদের জীবনযাত্রা সাধারণ হলেও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে দেখা যায় মাটির তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম, যা তাঁদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাতলার গ্রামে বিভিন্ন উৎসব ও মেলাতেও এই ঐতিহ্য ফুটে ওঠে।

 

**সাতলার ঐতিহ্যবাহী খাবার ও অতিথিপরায়ণতা**

সাতলা ইউনিয়নে গেলে স্থানীয় কিছু খাবারের স্বাদ নিতে ভুলবেন না। গ্রামের কিছু ছোট হোটেলে সহজ-সরল, কিন্তু সুস্বাদু খাবারের স্বাদ পাওয়া যায়। বরিশাল শহরে অনেক রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায়, যেমন পান্তা ভাত, ইলিশ ভাজা, চিতই পিঠা, মুগের ডাল, ইত্যাদি।

 

**কীভাবে যাবেন সাতলা বিলে**

ঢাকা থেকে বরিশালে পৌঁছাতে সড়ক, নৌপথ, বা বিমানপথে যেতে পারেন। সড়ক পথে গাবতলী থেকে ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বাস বরিশালের দিকে রওনা দেয়, যা সাধারণত মাওয়া ও পাটুরিয়া হয়ে বরিশাল পৌঁছায়। এসি বাসের ভাড়া ৭০০-৮০০ টাকা এবং নন-এসি বাসের ভাড়া ৫০০ টাকা। নৌপথে বরিশালে যেতে হলে সদরঘাট থেকে রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে বিভিন্ন লঞ্চ বরিশালের দিকে রওনা দেয়। সেখানে ডেকের ভাড়া ১৫০ টাকা, ডাবল কেবিনের ভাড়া ১৬০০ টাকা, এবং ভিআইপি কেবিনের ভাড়া ৪৫০০ টাকা। বরিশালে পৌঁছে নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে সাতলা পৌঁছাতে হয় শিকারপুর পর্যন্ত বাসে করে এবং সেখান থেকে অটো রিকশা নিয়ে যাওয়া যায়।

 

**সাতলা বিলে ঘোরার সুবিধা**

সাতলা বিলে ঘোরার জন্য স্থানীয়ভাবে ছোট ছোট নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়, যা দিয়ে আপনি শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। নৌকায় ভ্রমণের সময় শাপলার মাঝে সাদা বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, ফিঙে, শালিক এবং দোয়েল পাখির দল খেলা করে, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের মন জয় করে নেয়। গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রা, তাঁদের অতিথিপরায়ণতা, এবং শাপলার বিলের মুগ্ধকর দৃশ্য – সব মিলিয়ে সাতলা বিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

 

**খাবারের ব্যবস্থা**

সাতলা বিলে খাবারের তেমন কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেই। তবে বিলের পাশে কিছু ছোট দোকান থাকলেও সেখানে পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া যায় না। বরিশাল শহরে স্থানীয় কিছু হোটেল ও রেস্টুরেন্টে পছন্দের খাবার খেতে পারেন, বিশেষ করে মাছের তরকারি, চিতই পিঠা, দুধ চিতই, নারকেল চিতই এবং ইলিশ ভাজা।

 

**থাকার ব্যবস্থা**

সাতলা গ্রামে থাকার জন্য নির্দিষ্ট কোনো হোটেল বা রেস্ট হাউজ নেই, তবে গ্রামবাসীদের আন্তরিকতায় স্থানীয় বাড়িতে থাকতে পারেন। পূর্বে যোগাযোগ করে নিলে সুবিধা হবে। বরিশাল শহরে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে, যেখানে নিরাপদে থাকা যায়।

 

**সাতলা বিলের শাপলার উৎসব**

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে শাপলার প্রস্ফুটন উপলক্ষে সাতলায় এক ধরনের উৎসবের আমেজ শুরু হয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ শাপলা দেখার জন্য সমবেত হন। স্থানীয়রা তাঁদের তৈরি হস্তশিল্প, পিঠা, এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য বিক্রির জন্য ছোট ছোট দোকান বসান। এই প্রাণবন্ত পরিবেশে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা, সংগ্রাম এবং আনন্দ এক ভিন্ন অনুভূতি সৃষ্টি করে।

 

**সাতলা বিলে ভ্রমণের সময় মনে রাখবেন**

সাতলা বিলে ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সময় হল ভোরবেলা, কারণ তখন সূর্যের আলো শাপলার পাপড়িতে মিলিত হয়ে এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। ভ্রমণের সময় পর্যাপ্ত পানি, ক্যামেরা, এবং শুকনো খাবার নিয়ে যেতে ভুলবেন না। স্থানীয় পরিবেশ রক্ষা করতে গাছপালা বা শাপলা তুলে না ফেলে শুধুমাত্র চোখের সান্নিধ্যে প্রকৃতির রূপ উপভোগ করুন।

 

সাতলা বিল কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি স্থান নয়, এটি স্থানীয়দের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এবং অতিথিপরায়ণতার একটি মেলবন্ধন। শাপলার এই রাজ্যে এসে আপনি শুধুমাত্র প্রকৃতির সাথে মিলিত হবেন না, বরং গ্রামবাসীদের আন্তরিকতা, ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং তাঁদের সংগ্রামী জীবনযাত্রার সাথে পরিচিত হবেন। সাতলা বিল প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য একটি অবিস্মরণীয় গন্তব্য, যেখানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে একটি দিন কাটানো মানে জীবনের কিছু অমূল্য মুহূর্ত উপভোগ করা।

 

সাতলা বিলের শাপলার সৌন্দর্য ও স্থানীয়দের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানার পর নিশ্চয়ই সেখানে যেতে উদগ্রীব হবেন। প্রকৃতির এই অবিশ্বাস্য রূপ উপভোগ করতে, আপনিও সাতলা বিলে চলে আসুন এবং স্থানীয়দের আন্তরিকতার স্পর্শে নিজেকে হারিয়ে ফেলুন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রত্ন সাতলা বিল যেন আমাদের প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে থাকে।

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ

ঝলমলে আইপিএল নিলামের অন্য রূপ: কালো তালিকা, রাতারাতি কোটিপতি আর ক্ষমতা প্রদর্শন

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ললিত মোদি। ভারতীয় ক্রিকেট