ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০ ফুট গভীরে এক নদী প্রবাহিত হয় এবং সেখানে নৌকা চলে—এমন বিস্ময়কর নদীর সংখ্যা পৃথিবীতে খুবই কম। ফ্রান্সের পিরেনিজ পর্বতমালার কোলে এমনই একটি নদী রয়েছে। এই নদী ঘুরে লিখেছেন মইনুল হাসান। প্রতিবছর অন্তত কিছুদিনের জন্য ফরাসি কায়দায় ছুটি কাটানোর ইচ্ছা পরিহার করতে পারি না। এবার ঠিক করেছি, শহরের বাইরে, পর্বতে যাব। আমাদের গন্তব্য সাঁ-মার্তা, পিরেনিজ পর্বতমালার কাছে ফ্রান্সের একটি ছোট্ট গ্রাম। এটি তুলুজ শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত।
মহাসড়কের দুই পাশে ছোট পাহাড় এবং পাহাড়ের ঢালে হলুদ সূর্যমুখীর খেতগুলো রোদে ঝলমল করছে। কিছু দূর এগোলে পিরেনিজ পর্বতমালা সাদা তুষারচাপা চূড়ায় সূর্যের রশ্মি খেলা করছে—দৃশ্যটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। বিকেলে পথ ধরে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যে। আগেই ভাড়া করা একটি বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। বাড়ির নিচে রান্নাঘর এবং বসার ঘর ছিল, আর দোতলায় দুটি ঘর। বাড়িটির সঙ্গে একচিলতে মাঠ ছিল, যেখানে আরাম কেদারা এবং একটি আখরোট গাছ ছিল। দূরের পাহাড়ের কোলে ছবির মতো বাড়িটি, রাস্তা এবং সবুজে ঢাকা পরিবেশ শান্তিময় বিশ্রামের জন্য আদর্শ।
আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ফোঁয়া শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে লাবোউইচ এলাকায় ভূগর্ভস্থ নদীটি দেখতে যাব। এটি ইউরোপের সবচেয়ে দীর্ঘ নৌ চলাচলযোগ্য ভূগর্ভস্থ নদী। পিরেনিজ পর্বতমালার কাছাকাছি এই নদী প্রায় ৬০ মিটার বা ২০০ ফুট গভীরে অবস্থিত। ১৯০৮ সালের আগস্ট মাসে, চিকিৎসক জুল ডুনাক তাঁর দুই পুত্রকে নিয়ে জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে নদীটি আবিষ্কার করেন। ১৯৩৮ সাল থেকে এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
সকাল সকালে সেখানে পৌঁছে, পার্কিং, স্যুভেনির বুটিক এবং টিকিট কাউন্টার পেলাম। একটি রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার ১৫ থেকে ২০ ইউরো মধ্যে হয়ে যায়। মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নদীটি পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে, তবে জুলাই এবং আগস্ট মাসে এটি প্রতিদিন সকাল ৯:৩০ থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। নদীতে যেতে হলে একটি পাহাড়ি গুহার মুখে পৌঁছানোর পর ২৪০টি খাড়া সিঁড়ি বেয়ে পাতালে নামতে হবে। পাতালপুরীতে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ নৌবিহারের জন্য মাথাপিছু ১৪ দশমিক ৮০ ইউরো লাগবে। ১২ জনের একটি দল নৌকায় উঠবে এবং ফরাসি, ইংরেজি এবং স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষ একজন গাইড সাথে থাকবে। নিচে তাপমাত্রা সারা বছর ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে, তাই আমাদের দলের সবাই গরম কাপড় পরে নিয়েছিল।
ভূগর্ভস্থ নদীর সর্বোচ্চ গভীরতা ৩ মিটার বা ১০ ফুট। এটি পাঁচটি গ্যালারির মধ্য দিয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। নদীটি বিভিন্ন উপনদীতে বিভক্ত এবং এর মধ্যে রয়েছে গুপ্ত সুড়ঙ্গ এবং একটি চমৎকার জলপ্রপাত। এক জায়গায় মাথার ওপর ছাদের উচ্চতা ৩৫ মিটার বা ১১৫ ফুট। নদীটি এক অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যেখানে টুপটুপ করে পানি পড়ার শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। কোটি কোটি বছর ধরে বৃষ্টির পানি চুনাপাথর ক্ষয় করে এই ভূগর্ভস্থ নদী তৈরি করেছে। এখানে অসংখ্য চিত্তাকর্ষক স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট গঠিত হয়েছে।
দেড় কিলোমিটার পাতাল নৌভ্রমণে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে এবং আমাদের গাইড ছিলেন প্রাণবন্ত তরুণ আনাস। তিনি বলছিলেন, এখানে কোটি কোটি বছরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে। এটি সত্যিই অপূর্ব এবং অলৌকিক এক জগৎ, যা রূপকথার কাহিনিতেও পাওয়া যাবে না।