দ্যা নিউ ভিশন

অ্যাসিড সন্ত্রাসে চোখের আলো হারালেও আমার পড়াশোনা থামেনি।

দারিদ্র্য মোকাবিলা করে চিকিৎসক হয়েছেন আওলাদ হোসেন, আর অ্যাসিড সন্ত্রাসে দুই চোখ হারিয়েও নতুন দিনের আশা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন মাসুদা আক্তার। দুর্ঘটনায় বাবাকে হারিয়ে খাদিজা আক্তার এখন নার্সিং কলেজে ভর্তি হয়েছেন। আরও অনেক সংগ্রামী মানুষের মতো, এই তিনজনের যাত্রার পথে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মাসে তাঁদের তিনজনের জীবনযুদ্ধের কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। এখানে পড়ুন মাসুদা আক্তারের জীবনের গল্প।

 

রংপুরে আমরা তখন একেবারে নতুন। মা ও ভাইদের সঙ্গে পঞ্চগড় থেকে এসে নগরের একটি বাড়িতে উঠেছিলাম। ২০০৩ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর মা কঠিন সংগ্রামে লড়াই শুরু করেন, এবং রংপুরে এসে একটি কারখানায় কাজ নেন সংসার চালানোর জন্য।

 

আমি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিলাম। ভাইয়েরা আমাকে সাহায্য করছিল। সংসারটা অনেক কষ্টের হলেও মোটামুটি চলছিল। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় পাশের বাড়ি থেকে এক ছেলেটির বিয়ের প্রস্তাব আসে। সে নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল, কিন্তু মা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, আমি আরও কিছুটা বড় হই।

 

সমাজকল্যাণ বিদ্যাবীথি স্কুল ও কলেজ থেকে আমি জেএসসি পরীক্ষা দিলাম এবং ভালো ফলাফল করলাম। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করলাম। সাইকেল চালানো শিখে স্কুলে যাতায়াত করতাম। সবকিছু ভালো চলছিল, তবে একটি সমস্যা ছিল—পাশের বাড়ির ছেলেটি প্রায়ই আমাকে বিরক্ত করত। প্রায় তিন বছর ধরে সে আমাকে বিরক্ত করছিল, তার কথা শুনে আমি বেশ অসহায় হয়ে পড়েছিলাম।

 

২০১২ সালের ১৩ আগস্ট, রোজার মাসে, একটি ভোরে সাহ্‌রি খেয়ে নামাজ পড়ে মা ও আমি শুয়েছিলাম। হঠাৎ ঘরে এক ধরনের ঝলকানি দেখা যায়। মা বললেন, “ঝড় হবে হয়তো।” কিন্তু আকাশ পরিষ্কার ছিল। তখনই আমি শৌচাগারে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে, ফেরার পথে এক ব্যক্তি আমার কাঁধে হাত রাখল এবং মুখে তরল কিছু ছুঁড়ে মারল। আমার চোখ-মুখ ঝলসে গেল এবং আমি চিৎকার করে উঠলাম।

 

আশপাশের লোকেরা ছুটে এল এবং দ্রুত আমাকে রংপুর মেডিকেলে নিয়ে গেল। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর আমাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখানে আমার চিকিৎসা চলতে থাকে। আমার এক চোখ সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়, আর অন্য চোখের চিকিৎসা চলতে থাকে। পরে ভারতে গিয়ে আরও চিকিৎসা নেওয়া হয়, কিন্তু চূড়ান্ত ফল হয়নি।

 

ঘরে ফিরে আমি বুঝতে পারলাম, আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চোখের আলো হারানো এ দুঃখে আমি প্রায় মনোবল হারিয়ে ফেলেছিলাম, কিন্তু তারপর আবার মনে হলো, আমি হার মানব না। বাড়িতে ফিরে সুস্থ হয়ে আবার স্কুলে ভর্তি হলাম। কিন্তু পড়াশোনা কীভাবে করব, সেটা ছিল বড় প্রশ্ন।

 

ব্রেইল পড়তে না জানার কারণে, আমার দুই ভাই আমাকে তাদের বই পড়ে শোনাতো। ২০১৪ সালে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আমার কাহিনী প্রকাশিত হলে, প্রথম আলো ট্রাস্ট আমার পাশে দাঁড়ায়। তাঁদের সাহায্য নিয়ে ২০১৬ সালে মাধ্যমিক শেষ করি। এরপর ঢাকার শাজাহানপুরের মির্জা আব্বাস মহিলা কলেজে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে থাকি। ২০১৮ সালে শ্রুতিলেখকের সাহায্যে উচ্চমাধ্যমিক পাস করি এবং পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা শুরু করি।

 

অ্যাসিড হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আদালত রায় দিলেও, তাঁদের উৎপাত কমেনি। আমি এখন একা থাকি, আর মা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাঁর চিকিৎসা প্রয়োজন। তবে প্রথম আলো ট্রাস্টের সহযোগিতায় আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি এবং স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু, শিক্ষিত হলেও আমি অন্ধ—চাকরি পাওয়া কি আদৌ সম্ভব? একটি চাকরি আমার খুব প্রয়োজন!

 

**অনুলিখন: আবৃতি আহমদ**

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ

মিমি অবাক করেছেন

অভিনয়ে ম্যাজিক দেখানোর পাশাপাশি অনেক দিন ধরেই মিমি চক্রবর্তী নিজেকে