দারিদ্র্য এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়েই চিকিৎসক হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন আওলাদ হোসেন। অ্যাসিড-সন্ত্রাসে দুই চোখ হারিয়েও নতুন দিনের আশায় দিন গুনছেন মাসুদা আক্তার। দুর্ঘটনায় বাবাকে হারিয়ে, খাদিজা আক্তার এখন নার্সিং কলেজে ভর্তি হয়েছেন। এই তিনজনের মতো আরো অনেক লড়াকু মানুষকে সহায়তা দিচ্ছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে, শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’ তাদের সংগ্রামের গল্প ছাপা হয়েছে। এখানে পড়ুন আওলাদ হোসেনের জীবনযুদ্ধ।
কিশোরবেলায় এক প্রতিবেশীর মৃত্যু আমার হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। তিনি ‘পেট ফোলা’ রোগে আক্রান্ত ছিলেন, যা বর্তমানে লিভার সিরোসিস হিসেবে পরিচিত। সে সময় ওই অসচ্ছল মানুষটি কবিরাজি চিকিৎসা নিয়েছিলেন এবং চিকিৎসার অভাবে মাত্র এক বছরেই মারা যান। আমি তখন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, একদিন ডাক্তার হলে, আমি গ্রামে বিনা চিকিৎসায় কাউকে মারা যেতে দেব না।
ডাক্তারি পড়তে হলে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করতে হবে। আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয় হওয়ায় স্যাররা আমাকে অনেক পছন্দ করতেন এবং আমাকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য উৎসাহিত করতেন। তবে প্রাইভেট পড়ার মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্য আমাদের ছিল না। তাই, কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে আমি স্যারদের কাছে গিয়ে সাহায্য নিতাম, এবং তাঁরা আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে বুঝিয়ে দিতেন। ২০১০ সালে গাছতলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছিলাম, তবে আনন্দের চেয়ে আমার মা-বাবা দুঃখে কাঁদলেন। কারণ, তাঁরা জানতেন, ভালো রেজাল্ট করলেও আমাদের কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা নেই। আমার বাবা ছিলেন বর্গাচাষি, এবং আমাদের সংসারের রুজি-রোজগার চলত তাঁর পরিশ্রমে।
তবে একদিন প্রথম আলোর ধর্মপাশা প্রতিনিধি আমাদের বিদ্যালয়ে আসেন এবং শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে পরে আমাদের বাড়িতে গিয়ে রিপোর্ট করেন। রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকেই আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। প্রথম আলো ট্রাস্ট আমার পাশে দাঁড়ায় এবং ব্র্যাক ব্যাংক–প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে ময়মনসিংহের আলমগীর মনসুর কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। সেখানে আবারো আমি ক্লাসের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করি। ২০১২ সালে সেখান থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করি।
এরপর এমবিবিএসে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিই, এবং কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি টিউশনি শুরু করি, যাতে পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দিতে পারি এবং ছোট ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারি। ২০১৯ সালে আমি এমবিবিএস পাস করি এবং ৪২তম বিশেষ বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০২২ সালে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দিই। এক বছর সেখানে চাকরি করার পর, বর্তমানে আমি ধর্মপাশায় মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব পালন করছি।
এখন আমি জানি, আমাদের উপজেলার দরিদ্র মানুষজন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। তাই আমি প্রতি মাসে অন্তত একদিন বাজারের ফার্মেসি অথবা বাড়ির উঠানে বসে মানুষের চিকিৎসাসেবা দিই। এছাড়া, আমার উপজেলা সদরে একটি চেম্বার রয়েছে, যেখানে অসচ্ছল রোগীদের বিনা পয়সায় সেবা দিই।
এখন আমার লক্ষ্য মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হওয়া, এবং সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
জীবনে অভাব কখনো বাধা হতে পারে না, যদি মানুষের সদিচ্ছা, আত্মবিশ্বাস এবং কঠোর পরিশ্রম থাকে। অভাবের সংসারে, ছোটবেলায় যে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম, তা পূর্ণ করতে প্রথম আলো ট্রাস্টের সহায়তা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।