ইট, পাথর, ইস্পাতের পাশাপাশি এই স্কুলে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশ, কাঠ ও মাটি। শিক্ষার্থীদের যেন প্রকৃতির সাথে বেড়ে উঠতে পারে, তার জন্য চারপাশে রাখা হয়েছে সবুজ আর ছায়াময় পরিবেশ। এমন নকশার জন্য সম্প্রতি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের দুটি পুরস্কার পেয়েছে পাবনার চাটমোহরের বড়াল বিদ্যানিকেতন। স্কুলটি ঘুরে দেখেছেন সরোয়ার মোর্শেদ।
হেমন্তের এক সকালে পৌঁছে গেলাম চাটমোহরের কুমারগাড়া গ্রামে বড়াল বিদ্যানিকেতনে। পথে দেখলাম শিশুরা ব্যাগ কাঁধে স্কুলের দিকে দৌড়াচ্ছে। স্কুলে ঢুকে তারা প্রথমেই সারিবদ্ধভাবে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে। ব্যাগ রেখে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হলো। ধর্মগ্রন্থ পাঠ, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও শপথ শেষে কিছু শারীরিক কসরত করে শ্রেণিকক্ষে ফিরে গেল। এরপর সুরে সুরে শুরু হলো পড়া।
স্কুলের ভবনটি ঘুরে দেখে মনে হলো এটি আধুনিকতা আর ঐতিহ্যের মিলনস্থল। মূল উপাদানে ব্যবহার করা হয়েছে ইট, কাঠ, বাঁশ ও মাটি। একতলা দুটি ভবন ও মাঝখানে একটি দ্বিতল ভবন। একতলা ভবনগুলির ওপর মাটির টালি, জানালা নেই কিন্তু আলোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। সামনের ইটের গাঁথুনি এমনভাবে করা হয়েছে যে ফাঁকা অংশ দিয়ে আলো প্রবেশ করছে। পেছনে খোলা অংশে রোদ-বৃষ্টির আভাস পাওয়া যায়, যা শিক্ষার্থীরা উপভোগ করতে পারে।
দ্বিতল ভবনের নিচতলাটি পুরো খোলা; নেই জানালা বা দরজা। বাঁশের চাটাইয়ে ঝুলছে শিক্ষামূলক বিভিন্ন ছবি। মাঝখানে আছে একটি মাটির তৈরি শীতল পাঠাগার, যেখানে বই সাজানো। ভবনের দুই পাশে সিঁড়ি, যার একদিক দিয়ে উঠা যায়, অন্য দিক দিয়ে নামা যায়। দোতলায় পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। দরজা দিয়ে কক্ষে ঢোকা হয় এবং বিপরীত দিকে স্লাইড, যা প্রয়োজনে পুরোটা খোলা যায়। ভবনের সামনে রয়েছে আম, লিচু, কাঁঠালসহ বিভিন্ন গাছের বাগান।
শিক্ষাব্যবস্থাতেও রয়েছে বৈচিত্র্য। পড়াশোনার পাশাপাশি শেখানো হয় নাচ, গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা ও বিতর্ক। আছে কম্পিউটার ল্যাব। শিক্ষকরা জানান, শিক্ষার্থীরা যেন আনন্দ নিয়ে শিখতে পারে সেটিই তাঁদের লক্ষ্য। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলল, এখানে কেউ বকাঝকা করে না, বরং ভুল করলে শিক্ষকেরা হাসিমুখে বুঝিয়ে দেন।
বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালে। প্রথমে একটি টিনের ঘরে ৩০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ২৮১ জন শিক্ষার্থী আছে, শিক্ষক আছেন ১৭ জন। শিক্ষার্থীদের খরচের বেশির ভাগ বহন করেন ‘ভিত্তি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হাবিব ও তাঁর পরিবার। প্রধান শিক্ষক দিল আফরোজ বেগম জানান, তাঁদের লক্ষ্য শুধু ভালো ছাত্র নয়, ভালো মানুষ তৈরি করা।
বড়াল নদ রক্ষা আন্দোলন চলাকালেই এই বিদ্যালয়ের ধারণা আসে। আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত মিজানুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী দিল আফরোজ গ্রামে ফিরে শিশুদের পড়ানো শুরু করেন। ২০১৯ সালে প্রয়াত শাহনাজ বেগমের আর্থিক সহায়তায় প্রথম ঘরটি নির্মিত হয়।
পরে ইকবাল হাবিব এক সফরে স্কুলটি পরিদর্শন করে উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর নকশায় তৈরি ভবনটি পরিবেশবান্ধব ও খোলামেলা। এখানে বৃষ্টি পড়লে শিক্ষার্থীরা তা উপভোগ করতে পারে, আবার রোদও পাওয়া যায়। ভবনের সামনে শান্তিনিকেতনের আদলে রয়েছে আমগাছ।
স্কুল ভবনের প্রথম স্তরের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি দুই স্তর পর্যায়ক্রমে হবে। এই নকশার জন্য ইকবাল হাবিব আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের দুটি পুরস্কার জিতেছেন। মিজানুর রহমান জানান, স্কুলটির আয় দিয়েই ভবিষ্যতে নিজে চলবে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা হবে, যাতে অন্যান্য এলাকার শিক্ষার্থীরাও এখানে পড়তে পারে।