দ্যা নিউ ভিশন

নভেম্বর ২৫, ২০২৪ ০৭:৩৮

আমাদের ভুলটা আসলে কোথায়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করার পর বিদেশে পড়ার ইচ্ছে আমার মাথায় ঢুকেছিল। ভালো রেজাল্টের জন্য মা-বাবাও আমাকে উৎসাহিত করলেন, তবে তাদের শর্ত ছিল, পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরতে হবে।ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে শুরু করলাম। একপর্যায়ে স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগো এবং নেদারল্যান্ডসের মাসট্রিক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম। কিন্তু বৃত্তি না পেলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সম্ভব নয়। তাই নতুন করে বৃত্তির সুযোগ খুঁজতে লাগলাম।

 

প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু আংশিক ফি মওকুফের ব্যবস্থা থাকলেও মাস্টার্সের জন্য সম্পূর্ণ টিউশন ফি ও অন্যান্য খরচ মেটানোর মতো বৃত্তির সুযোগ ইউরোপে কম। তবে নানা দেশে বিপাকে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু সরকারী সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশিপ এবং বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা। এই ফেলোশিপগুলোতে সম্পূর্ণ টিউশন ফি, মাসিক উপবৃত্তি এবং বিদেশ যাওয়ার ফ্লাইট খরচ মেলে।

 

বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপের জন্য আবেদন করতে হলে ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ র‍্যাঙ্কিংয়ে ৩০০-র মধ্যে থাকা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার লাগবে, এবং প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশিপের জন্য র‍্যাঙ্কিং ১৫০-এর মধ্যে থাকতে হবে। আগে বিদেশে মাস্টার্স ডিগ্রি থাকতে হবে না, এবং পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরতে হবে। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছি, দুটিই শীর্ষ ১৫০-র মধ্যে রয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপের জন্য আবেদন প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম।

 

যেদিন ফেলোশিপ আবেদনের সময়সীমা শেষ, সেদিনই আমি কাগজপত্র জমা দিলাম। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার, চাকরির সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি, শিক্ষাজীবনের সকল সনদপত্র—রীতিমতো হাবুডুবু খেতে হলো। ফলাফলের অপেক্ষায় আরও কিছু বৃত্তির জন্য আবেদন করলাম।

 

৩০ জুন ফেলোশিপের ফলাফল বের হলো। কাঁপা হাতে ফলাফলের লিংকে ক্লিক করে প্রথম দুজনকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল সায়েন্স নিয়ে নির্বাচিত হতে দেখলাম। এরপর আরও দুজনের নাম দেখলাম। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে একজন জনস্বাস্থ্য এবং অন্যজন নগর পরিকল্পনা নিয়ে পড়তে যাচ্ছেন। আশা হারিয়ে ফেললাম। মনে হলো এত মেধাবীর মধ্যে আমার নাম খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু ২১ নম্বরে গিয়ে মাসট্রিক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পড়ার জন্য আমার নামটি দেখতে পেলাম।

 

এবার আরও অনেক কাগজপত্র জমা দেওয়ার পালা। দুই বছরের ডিগ্রি শেষে দেশে ফেরার অঙ্গীকারনামা জমা দিলাম, যা সরকারি কর্মকর্তার সত্যায়িত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে হতে হবে। মেডিকেল ফিটনেস সনদও জমা দিতে হলো, পাশাপাশি প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার সত্যায়িত কিছু কাগজও জমা দিলাম। দ্বিতীয় ধাপে কাগজ জমা দেওয়ার পর সরকারি আদেশ ও ভিসা আবেদনের জন্য স্পনসরশিপ চিঠি পেলাম।

 

১৫ জুলাইয়ের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে লাগলাম, তবে ভেতরে ভেতরে ভয় কাজ করছিল—এই ‘অপরাধে’ আমার ফেলোশিপ বাতিল হয়ে যাবে। তখন অনলাইনে প্রতিবাদ করার কারণে অনেককে কঠিন মাশুল দিতে হচ্ছিল। মনে আছে, ফেলোশিপ অফিসে বসে আতঙ্ক হচ্ছিল এক প্রোফাইল ছবি বদলানো নিয়ে। যেন কেউ এসে বলবে, ‘তুমি বের হয়ে যাও! এই সুযোগ প্রতিবাদীদের জন্য নয়।’

 

৫ আগস্ট সরকারের পতনের রোমাঞ্চে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। ২১ আগস্ট প্রথম ফেসবুকে দেখলাম, পুনর্মূল্যায়নের আশ্বাস ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ বাতিল করা হয়েছে। অনেকের ফেলোশিপ বাতিল হওয়ার পর তারা নিজ খরচে বিদেশ চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, তাদের ফান্ডিং আর নেই।

 

প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ বাতিল হওয়াটা আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াল—বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপও হয়তো বাতিল হতে পারে। তখন ফেলোশিপ অফিসে ছুটোছুটি শুরু করি। তারা জানান, নিরপেক্ষভাবেই শিক্ষার্থী নির্বাচন হয়েছে এবং শিগগির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক হবে, সেখানে ফেলোশিপের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হবে। শুনে কিছু আশা হলো, মনে হল নির্বিচারে ফেলোশিপ বাতিল হবে না। তবে অপেক্ষা না করে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ই-মেইল করা শুরু করি। আগস্টের মাঝামাঝি থেকে ২০২৪ সালে পড়াশোনার বৃত্তির আবেদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়ে বুঝলাম, ফেলোশিপ বাতিল হলে আরও এক বছর অপেক্ষা ছাড়া উপায় থাকবে না।

 

সরকার পতনের এক মাস পরও ফেলোশিপ বাতিলের খবর আসে না। ফেলোশিপ অফিসে যোগাযোগ করলে তারা জানান, নির্বাচন প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ ছিল। এর মধ্যে ফেলোদের পক্ষ থেকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ থাকলে পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদন করা হয়। বাংলাদেশের স্বচ্ছতার জায়গা থাকা উচিত।

 

সরকার পতনের ৩৭ দিন পর ওয়েবসাইটে একটি প্রজ্ঞাপন জারি হলো, যা জানায়, ‘৩০ জুনের প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হলো।’ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ফেলোশিপ আদেশ, ফলাফল ও আবেদন আহ্বানের তথ্য ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো। ওয়েবসাইটে আর কোনো ফেলো নির্বাচনের প্রক্রিয়ার চিহ্ন নেই।

 

ফেলোশিপ বাতিলের পরও কয়েকবার ওয়েবসাইটে গিয়ে ঠুনকো আশা নিয়ে দেখলাম, ফেলোশিপ কমিটির কর্মকর্তাদের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বদলেছে শুধু নোটিশ বোর্ড, যেখানে ফলাফল বাতিল হওয়ার তথ্য ছাড়া কোনো নতুন তথ্য নেই।

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ

ঝলমলে আইপিএল নিলামের অন্য রূপ: কালো তালিকা, রাতারাতি কোটিপতি আর ক্ষমতা প্রদর্শন

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ললিত মোদি। ভারতীয় ক্রিকেট