নর্থ সুইডেনের ছোট্ট গ্রাম অ্যালিট্র্যাস্কে আমাদের দ্বিতীয় সফর। লেকের পাড়ে অবস্থিত ওই অদ্ভুত সুন্দর বাড়িটি আমাদের সুইডিশ বন্ধু ক্রিস্টোফারের গ্রামের বাড়ি। সুইডিশরা এ ধরনের বাড়িগুলোকে স্তুগা বা কেবিন বলে।এবারের সফরে ক্রিস্টোফার আমাদের সঙ্গে নেই, তবে তার বাবা রোলফ নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছেন, যদিও তিনি এখানে সাত কিলোমিটার দূরে থাকেন। এই পরিবারের সদস্যরা খুব দ্রুত মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। ক্রিস্টোফারের বাবা রোলফ এবং মা গুন্নেলও এর ব্যতিক্রম নন। তাঁদের সাথে দেখা হলে সত্যিই উজ্জীবিত হই; বয়স কেবলই সংখ্যা!
একদিন ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যার দিকে কফি হাতে বসে ছিলাম। হঠাৎ বিশাল ট্রেলার নিয়ে হাজির হলেন রোলফ চাচা, ‘জঙ্গলে নতুন অভিজ্ঞতা নিতে চাও? চলো।’
এত কিছু জানতে না চেয়েই দ্রুত বেরিয়ে এলাম। বুঝতে পারছিলাম, এই পরিবারের সঙ্গে যাত্রা মানেই নতুন কোনও অ্যাডভেঞ্চার।
গাড়িতে করে জঙ্গলের দিকে এগোতে লাগলাম। গল্প করতে করতে জঙ্গলের কাছে একটা বাড়িতে থামলেন। ট্রেলার থেকে রবারের বিশাল ট্রে নামিয়ে নিয়ে আসলাম। কিছুক্ষণ পর সেখানে ক্রিস্টোফারের বড় ভাই ক্রিস্তের সঙ্গে আরও একজন অপেক্ষা করছিল। তাঁরা আগে থেকেই আমার পরিচিত। ট্রেলার থেকে বিশাল ট্রেটি নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
কিছু দূর এগিয়ে একটি জটলা দেখে মাটিতে পড়ে থাকা বিশাল এক মুজকে দেখতে পেলাম। ক্রিস্তের লাইসেন্সধারী শিকারি এবং তার গুলিতেই এই মুজ মারা পড়েছে। তাঁরা এখন ট্রেটাতে করে সেটি নিয়ে যেতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। দ্রুত কাজ শুরু করে মুজের পেট চিড়ে ভুঁড়ি বের করে ফেললেন। এরপর মুজটিকে ট্রেতে তোলা হলো।
২৫০ কেজির এই প্রাণীকে টেনে নিয়ে আসা সহজ কাজ ছিল না। রাস্তায় আসার পর সেটিকে ট্রেলারে তোলা হলো। পরে, রোলফ চাচা আমাদের নিয়ে আরেক সদস্যের বাড়িতে গেলেন, যেখানে মুজ কাটাকাটি করে মাংস সংরক্ষণ করা হবে।
আমি তাদের কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হচ্ছিলাম। বাড়ির সামনে বিশাল একটি কক্ষে ট্রেটি ঢোকানো হলো। দেখলাম, এখানে শিকারের পশু কাটার কাজ হয়। দ্রুত চামড়া ছাড়িয়ে ফেললেন তারা। কাজ শেষ করে আমাদের বিদায় জানিয়ে রোলফ চাচা চলে গেলেন।
আমি আগে ভাবতাম, এই বরফের দেশে এসব গ্রামে মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করে। এবার বুঝলাম, এসব থ্রিলিং অভিজ্ঞতাই তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ।
বাড়িতে ফেরার পথে আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ভাগ্য আমাদের সঙ্গে আছে। উত্তরের আকাশে আলোর নাচন অরোরা বা নর্দান লাইট দেখা দিল। এটির জন্য বহু মানুষ নর্থ সুইডেন বা নরওয়ে আসে, যদিও দেখা পাওয়া সম্পূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার।
বাইরের তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই মাইনাসে পৌঁছেছে। কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার পর ক্ষুধা অনুভব করলাম। দ্রুত পাস্তা রান্না করে খেয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিলাম। অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের বেডরুমের বিশাল জানালায় নতুন করে আলোর প্রদর্শনী শুরু হল। বিছানায় শুয়ে এমন দৃশ্য দেখা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
জীবন আসলে একটি জাদুর বাক্স; কখন কী রোমাঞ্চ বেরিয়ে আসবে বলা যায় না। কেবল আকাঙ্ক্ষা ও ধৈর্য প্রয়োজন।