দ্যা নিউ ভিশন

নভেম্বর ২৫, ২০২৪ ০০:৩৫

জীবনটাই বদলে গেল রে, মা

মা ধীরে ধীরে এগিয়ে যান, একটু একটু করে চোখের সামনে স্পষ্ট হয় সাদা ফেনারাশির ঢেউ। দূরের দিকে তাকিয়ে মা বুঝতে পারেন সাগরের অস্তিত্ব। আমি পাশে থেকে তাঁর মুখের প্রতিটি অভিব্যক্তি দেখার জন্য হাঁটতে থাকি। হঠাৎ মা আমার হাত শক্ত করে ধরে বলেন, ‘আমার পায়ে কী যেন লাগল?’ নিচে তাকিয়ে দেখেন, সমুদ্রের জল! সাগরের জল স্পর্শ করছে তাঁর পায়ের পাতা। মা বিস্ময়ে আর আনন্দে হতবাক, আর আমার চোখে সেই স্বপ্নপূরণের অশ্রু। অবাক হয়েছিলাম জেনে যে, মা–বাবা কখনো কোথাও বেড়াতে যাননি। আর কক্সবাজারে সমুদ্র দেখা—সেটা তো তাঁদের কাছে কল্পনাতেও আসেনি।

 

যখনই মাকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘তুমি সমুদ্র দেখেছ?’ মা হাসিমুখে বলতেন, ‘হুমম, টিভিতে অনেক দেখেছি।’

 

বাবার বয়স ৭০ পেরিয়েছে, আর মা ৬০-এর কাছাকাছি। এত বছরেও তাঁরা নিজের চোখে সমুদ্র দেখেননি, এটা ভাবতেই পারিনি। আমাদের তো শিক্ষা সফর, বন্ধু বা সহকর্মীদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া—এসব কতবার হয়েছে। অন্তত একবার সমুদ্র দেখা তো আমাদের জীবনেই হয়ে যায়।

 

তবু, মা–বাবা কেন সমুদ্র দেখবেন না? তাঁদের শরীর এখনো চলে, কিন্তু আরও কিছুদিন পর হয়তো চলাফেরাও কঠিন হয়ে যাবে। তাঁদের জীবনেও সমুদ্র দেখা হবে না?

 

এটা মেনে নিতে পারলাম না। ভাইবোনদের বললাম, পূজার ছুটিতে মা-বাবাকে সমুদ্র দেখাতে যাব।

 

প্রথমে সবাই রাজি হলেও পরে একেকজনের ব্যস্ততা আর সমস্যা দেখা দিল। মায়ের-বাবার বয়স হয়েছে, মানচিত্রের উত্তরে ছোট্ট শহর থেকে দক্ষিণে যাওয়া মানে অনেক ধকল, সময় আর খরচ। বাবার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ঘন ঘন বাথরুম যাওয়ার সমস্যা—সব মিলিয়ে কক্সবাজার যাওয়া যেন অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।

 

তবে আমার জেদ চেপে গেল। আমি আমার মা-বাবাকে সমুদ্রের জলে পা ভেজাতে দেখতে চাই। সেই প্রথম স্পর্শে তাঁদের বিস্ময় আর মুগ্ধতা দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করতে রাজি নই। শুরু করলাম উদ্যোগটা। বিমানে যাত্রার পরিকল্পনা হলো, টিকিটের ব্যবস্থা করল এক ভাইবোন, ঢাকায় আসা-যাওয়ার দায়িত্ব আরেকজনের। কক্সবাজারের পোশাক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থাও হলো।

 

বাবা চাকরিজীবনে সবকিছু ত্যাগ করে আমাদের গড়ে তুলেছেন, মা পুরোটা জীবন সংসার আর আমাদের যত্নেই কাটিয়েছেন। বেড়ানোর কথা তো ভাবাই হয়নি কখনো। কাজেই তাঁদের বেড়ানোর জন্য রাজি করানোটা সহজ ছিল না, তবুও হলো।

 

বাড়ি থেকে ঢাকার ট্রেনে মা-বাবাকে তুলে দিলেন ছোট ভাই। ঢাকায় এক রাত বিশ্রামের পর, পরদিন বিমানে কক্সবাজার। দূরপাল্লার বাসেই যাঁদের আপত্তি, তাঁরা এবার জীবনে প্রথম বিমানযাত্রায় অবাক হয়ে সবকিছু দেখছিলেন। বিমানে উঠেই সিটবেল্ট, মেঘের ভেতর দিয়ে উড়ে যাওয়া—সবকিছুতেই তাঁদের চোখে বিস্ময়। আমি মায়ের পাশে বসে মেঘের মধ্যে ডানা দেখিয়ে বললাম, ‘কেমন লাগছে?’ মা বললেন, ‘এ তো স্বপ্ন!’ বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনি মন ভরে এ দৃশ্য উপভোগ করছেন। বললেন, ‘জীবনে আমার জন্য এও লেখা ছিল নাকি, মা?’

 

কক্সবাজারে পৌঁছে প্রথমে সূর্যাস্তে ইনানী বিচে যাই। পরদিন সকালে সমুদ্রের কাছে মা-বাবাকে নিয়ে গেলাম। মা বালুর ওপর হাঁটতে হাঁটতে শিশুর মতো উল্লসিত, কখনো দূরে তাকাচ্ছেন, কখনো সাগরের জল স্পর্শ করছেন। এরপর তাঁকে সাগরের জলে পা ভেজাতে দিই। দূর থেকে দেখি মা-বাবা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দিগন্তরেখার দিকে তাকিয়ে আছেন। জীবনে তাঁরা কখনো পরস্পরের সান্নিধ্য উপভোগ করতে কোথাও যাননি। এবার যেন সাগরের নীরবতায় তাঁরা নিজেরাই নিজেদের কথা শোনেন।

 

বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা, সমুদ্রের অভিজ্ঞতা কেমন?’ বাবা বললেন, ‘জীবনটাই বদলে গেল রে মা।’

 

আর মা? তাঁর একটাই কথা, ‘আবার কবে সমুদ্রে যাব?’

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ

ঝলমলে আইপিএল নিলামের অন্য রূপ: কালো তালিকা, রাতারাতি কোটিপতি আর ক্ষমতা প্রদর্শন

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ললিত মোদি। ভারতীয় ক্রিকেট