এক বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজার বিশাল অংশ বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। সেখানকার অনেক এলাকা এখন বসবাসের অনুপযোগী। গত মে মাসে জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, গাজায় গৃহহীন মানুষের জন্য ধ্বংসাবশেষ সরাতে ১৫ বছর, অর্থাৎ ২০৪০ সাল পর্যন্ত সময় প্রয়োজন হবে। ইসরায়েলের বেসামরিক স্থাপনায় এ ধ্বংসযজ্ঞ নতুন কিছু নয়। এটি তাদের যুদ্ধনীতির একটি অংশ, যা ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ নামে পরিচিত।
ইসরায়েল প্রথম গাজায় এই যুদ্ধনীতি প্রয়োগ করেনি। ২০০৬ সালে লেবাননে এই নীতি প্রথম ব্যবহার করা হয়। এখন, অক্টোবরের শুরু থেকে, ইসরায়েল আবারও এই কৌশল প্রয়োগ করেছে। বর্তমানে, লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ও বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইসরায়েলি আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে। লেবাননের মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে।
### ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ কী?
ইনস্টিটিউট অব মিডল ইস্ট আন্ডারস্ট্যান্ডিং (আইএমইইউ) অনুযায়ী, ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ হলো অসম শক্তি প্রয়োগের একটি ইসরায়েলি যুদ্ধনীতি, যেখানে বেসামরিক মানুষের ওপর ইচ্ছাকৃত আক্রমণ চালানো হয়। চলমান গাজার যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের আঞ্চলিক পরিচালক আবদুল্লাহ আল-দারদারি মন্তব্য করেছেন, “১৯৪৫ সালের পর এমন কিছু দেখা যায়নি। গত ৪০ বছরে গাজার উন্নয়ন কার্যক্রমের সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা যেন ১৯৮০-এর দশকে ফিরে গেছি।”
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন শাখার (আঙ্কটাড) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের সেনা অভিযানের ফলে গাজায় এক নজিরবিহীন মানবিক, পরিবেশগত ও সামাজিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। গাজার অর্থনীতি প্রাক্-উন্নয়ন অবস্থায় ফিরে গেছে। জাতিসংঘ জানাচ্ছে, যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠিত হলে ২০২২ সালের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অনুসরণ করলেও গাজার বাসিন্দাদের ৩৫০ বছর সময় লাগবে যুদ্ধপূর্ব জিডিপি পুনরুদ্ধার করতে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধ্বংসযজ্ঞের উদ্দেশ্য হলো সরকার বা গোষ্ঠীর প্রতি জনগণের সমর্থন ভেঙে দেওয়া, যাতে তারা ওই সরকার বা গোষ্ঠীকে পরিত্যাগ করে। তবে, এই নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে ইসরায়েলের উদ্দেশ্য কতটা সফল হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
### ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ এর উৎপত্তি
‘দাহিয়া’ শব্দটি লেবাননের বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠের একটি এলাকায় ব্যবহৃত হয়, যা দাহিয়েহ নামেও পরিচিত। সেখানে হিজবুল্লাহর প্রধান সদর দপ্তর অবস্থিত। ২০০৬ সালে ইসরায়েলি বাহিনী দাহিয়াকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল, প্রায় এক হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে। ইসরায়েল ওই সময়ে লেবাননের বিদ্যুৎকেন্দ্র, পানিশোধন কেন্দ্র, সেতু, বন্দর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক স্থাপনায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর তৎকালীন নর্দান কমান্ডের প্রধান জেনারেল গাদি আইজেনকট ২০০৮ সালে এই নীতির উদ্বোধন করেন। তিনি ভবিষ্যত যুদ্ধে এই নীতির প্রয়োগের কথা জানান। ২০০৮-২০০৯ সালে গাজায় এ নীতি প্রয়োগ করা হলে ১,৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল সেসময় ইচ্ছাকৃতভাবে অসম শক্তি প্রয়োগ করে গাজার অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়।
### ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ প্রয়োগের উদ্দেশ্য
ইসরায়েল এই নীতি প্রয়োগ করে মূলত শত্রু পক্ষের জনগণকে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সমর্থন কমাতে চায়। এর মাধ্যমে তারা জনগণকে বিরোধী গোষ্ঠী বা সরকারের প্রতি সহানুভূতি বা সমর্থন প্রত্যাহারের জন্য চাপ তৈরি করতে চায়। অন্যদিকে, বেসামরিক স্থাপনা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে তারা বিরোধী পক্ষকে দুর্বল করে দিতে চায়, যাতে যুদ্ধ শেষে ওই দেশের পুনর্নির্মাণ বা নতুন করে শক্তি অর্জন করা কঠিন হয়।
বিশেষ করে, ইসরায়েল একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখতে এই কৌশল প্রয়োগ করে থাকে। ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো এমন এক শক্তির ভারসাম্য তৈরি করা, যাতে তাদের প্রতিপক্ষের পক্ষে সংঘাতে জড়ানোর সাহস না থাকে। এই নীতির মাধ্যমে, ইসরায়েল প্রতিপক্ষকে দুর্বল রেখে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়।
### বর্তমান পরিস্থিতি
গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলার ফলে প্রায় ৪৩ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৭০% নারী ও শিশু। এছাড়া, এক লাখের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। ইসরায়েলি বাহিনী এখনও গাজায় ‘পোড়ামাটি নীতি’ প্রয়োগ করছে, যার ফলে অঞ্চলটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
এদিকে, ১ অক্টোবর থেকে লেবাননে ইসরায়েল সর্বাত্মক হামলা শুরু করেছে। দাহিয়া এলাকার পাশাপাশি, দক্ষিণ লেবাননও বর্তমানে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এবং হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা হয়েছে।
### শেষ কথা
ইসরায়েলের ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশাল মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে, কিন্তু এর লক্ষ্য হলো শত্রু পক্ষকে রাজনৈতিক বা সামরিকভাবে দুর্বল করে রাখা। তবে, এই নীতি প্রয়োগের পর যে মানবিক বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিণতির দিকে পরিচালিত করতে পারে, যা পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে।
**তথ্যসূত্র**: আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্ট