দ্যা নিউ ভিশন

নভেম্বর ২৪, ২০২৪ ২৩:৫২

সচেতন হলে স্তন ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব।

নিজের উপার্জনের টাকায় কেনা একটি খেত এবং বাবার বাড়ি-ভিটা বিক্রি করে পাওয়া অর্থে চলছে চিকিৎসা। গরিবের এত বড় অসুখ ক্যান্সার—চিকিৎসা করতে গিয়ে সর্বস্ব হারানো মোছা. সোমা আক্তার এসব কথা বলছিলেন। দুপুর ২টা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিচ তলার ক্যান্সার বিভাগ, ১০৩ নম্বর ওয়ার্ড। নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ থানার বাকুরপুর গ্রামের ৩৬ বছর বয়সী সোমা বলেন, “১০/১১ বছর বয়সে বাবা মারা যান। একটু বড় হলে, অভাবের সংসারে হাল ধরতে গার্মেন্টে কাজ শুরু করি নরসিংদীতে। পরে ছোট চার বোনের বিয়ে দিয়েছি, মা ও নিজের খরচ চালাতে নিজের বিয়েও করি নাই। একবার জ্বরের সময় লক্ষ্য করি, ডান স্তন শক্ত হয়ে গেছে। ডাক্তারকে দেখাতে গিয়ে তিনি আমাকে ঢাকায় সরকারি হাসপাতালে যেতে বলেন, কিন্তু অভাবের কারণে সময় করে উঠতে পারিনি। সাত মাস পর স্তনে প্রচণ্ড ব্যথা ও জ্বর হলে ডাক্তারকে দেখাই, তখন ডান স্তনে চারটি মুখ পেকে পুঁজ বের হচ্ছিল। উপজেলা হাসপাতালের ডাক্তার দ্রুত হাসপাতালে আসতে বলেন। এখন এই হাসপাতালে ডান স্তন কেটে ফেলা হয়েছে। আমার দুই স্তনে টিউমার আছে, কিন্তু একসঙ্গে দুইটি অপারেশন করা যাবে না বলে একটি করে অপারেশন করা হচ্ছে। এখন কেমোথেরাপি চলছে। ডান বুকের কাটা শুকালে বাম স্তন অপারেশন করা হবে।”

 

এভাবেই কথা বলছিলেন নরসিংদীর মনোহরদি থানার পাটকান্দি গ্রামের ৫০ বছর বয়সী সুফিয়া বেগম। তার ডান হাতের কুনুইয়ের ওপরে ফুলে গেলে এবং ব্যথা শুরু হলে তিনি চিকিৎসকের কাছে যান, যিনি তার স্তনে টিউমার শনাক্ত করেন। ধামরাই থানার পটল গ্রাম থেকে আসা ৬০ বছরের মালেকা বেগম এবং ঢাকা দোহার উপজেলার জয়পাড়া বাজারের কাটাখালী থেকে আসা ৫০ বছর বয়সি নুরজাহান বেগমও একই অবস্থা পেরিয়ে এসেছেন।

 

অজ্ঞতা ও অসচেতনতায় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএআরসির তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর নতুন করে ১৩ হাজার নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ৮ হাজার নারী মারা যান। বর্তমানে বিশ্বে নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসার অন্যতম প্রধান ক্যানসার, যেখানে প্রতি বছর ২০ লাখের বেশি নারী এই রোগে আক্রান্ত হন এবং মারা যান প্রায় ৭ লাখ।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্তনের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমারে পরিণত হয়। এই টিউমার রক্তনালী ও লসিকা মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, যা ক্যানসারের কারণ হয়। অক্টোবর মাসে স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস হিসেবে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

 

রাজশাহী ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক ডা. পেট্রিক বিপুল বিশ্বাস ইত্তেফাককে জানান, “আমাদের হাসপাতালে আসা রোগীদের ৯০ ভাগ স্তন ক্যানসার আক্রান্ত। যারা আসেন, তাদের মধ্যে ৫ থেকে ১০ ভাগ হয়তো কোনো একটি স্তরে থাকে; বাকিরা সাধারণত বেশ অ্যাডভান্সড স্টেজে আসেন। অনেক সময় তারা বুঝতে পারেন না, যখন বুঝতে পারেন, তখন হয়তো কিছুটা ব্যথা অনুভব করেন; স্বামীকে জানান, কিন্তু তিনি তেমন গুরুত্ব দেন না। যখন টিউমার বড় হয়, তখন তারা জেনারেল ডাক্তারকে নিয়ে যান। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, “বাংলাদেশে ১৩০ জন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ আছেন। তারা কিছু চিকিৎসা দেন, টাকা-পয়সা খরচ করেন, কিন্তু ভালো কিছু হয় না। এভাবে সময়ক্ষেপণ করে রোগীরা শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে আসেন। সচেতনতার অভাব এবং আর্থিক সমস্যাগুলো দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার কারণ।”

 

ডা. পেট্রিক বিপুল বিশ্বাস আরও বলেন, “আমরা স্তন ক্যানসার দিবসে এক দিনের জন্য বিনামূল্যে সেবা দিয়েছি—এটি এমন নয়। আমাদের হাসপাতাল অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখানে একটি মিনিমাম চার্জ নেওয়া হয়। যদি কেউ চার্জ দিতে না পারেন, তবে আমরা তাকে বিনামূল্যে সেবা প্রদান করি।”

 

বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, “অল্প সচেতনতায় এই ব্যাধিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। ঝুঁকিতে থাকা ৯ শ্রেণির নারী নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে এই বিপদ এড়িয়ে যেতে পারেন। ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে নারীরা ম্যামোগ্রাফিক স্ক্রিনিং করে এ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। ২০ বছর বয়স থেকে নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।”

 

সচেতনতাই পারে এই রোগ প্রতিরোধ করতে:

 

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি, লালমাটিয়া কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টার মাসব্যাপী বিনামূল্যে নারী চিকিৎসক দিয়ে স্তন স্ক্রিনিং সেবা প্রদান করবে। বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্বল্প খরচে সব ধরনের পরীক্ষা ও অতি দরিদ্র রোগীদের মাত্র ৫ হাজার টাকায় অপারেশন করার সুযোগ রেখেছে মাসব্যাপী।

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ