বলিউডের প্রবীণ অভিনেতা অনুপম খের। আজ শুক্রবার ৭০ বছরে পা রাখলেন এই গুণী অভিনেতা। শুরুটা ভারতের হিমাচল প্রদেশ থেকে। নিজেকে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মুম্বাই গিয়েছিলেন মাত্র ৩৭ টাকা নিয়ে। সেখানে প্রথম জীবনটা খুব কষ্টের ছিল, এক মাস তাঁকে রেলস্টেশনে ঘুমাতে হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংগ্রামের সেই দিনগুলোর কথা লিখেছেন তিনি। আজ জন্মদিন জানব তাঁর জীবনের জানা– অজানা গল্প।
চলচ্চিত্র সমালোচকদের মতে, বলিউডে তাঁর মতো বহুমুখী প্রতিভার অভিনেতা কমই এসেছেন। কমেডি হোক, সিরিয়াস হোক কিংবা খলনায়কের চরিত্র হোক—সব চরিত্রকেই দক্ষতার সঙ্গে পর্দায় ফুটিয়ে তোলায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। চার দশকের বেশি সময় তিনি পর্দায় অভিনয় করছেন। এই সময়ে বিচিত্র চরিত্রে দেখা গেছে তাঁকে। কৌতুক, খল অভিনেতা, বিত্তশালী বাবা কিংবা রাজনীতিবিদ! সব চরিত্রে মানিয়ে যান বলিউডের অন্যতম বর্ষীয়ান অভিনেতা অনুপম খের। টাক মাথার লোকটা শুধু অভিনয়গুণ দিয়ে বারবার আলোচনায় এসেছেন। যদিও ‘বর্ষীয়ান’ শব্দটা তাঁর মোটেও পছন্দ নয়। চলাফেরাতেও তিনি সবুজ!
৫০০–এর বেশি ছবিতে এখন পর্যন্ত অভিনয় করেছেন তিনি। ক্যারিয়ারে অনেক ওঠানামাও দেখেছেন। কিন্তু আজও অভিনয় ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন না তিনি। আবার এমনও দেখা গেছে, এই বয়সে ফিটনেসের জন্যও আলোচনা হচ্ছে তাঁকে নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুপম খেরের জিমের ছবি দেখলে তাক লেগে যায়। বর্ণাঢ্য জীবনযাপন তাঁর।
জনপ্রিয় এ তারকার অভিনয়জীবনের শুরুটা নিদারুণ সংগ্রামের ছিল। অর্থের অভাব ছিল, থাকার জায়গা ছিল না। এমনও অনেক রাত গেছে তাঁর, সমুদ্রের তীরে সৈকতের বালুতে বা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘুমাতে হয়েছে তাঁকে। মায়ের কাছে মিথ্যা বলে ১০০ টাকা নিয়ে অডিশন দিতে গিয়েছিলেন অনুপম খের।
একেবারেই নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ অনুপম খের। বাবা ছিলেন বন বিভাগের সাধারণ এক কেরানি। অনুপম খের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজে নিজেই জীবনসংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সময়। তিনি লিখেছেন, ‘যখন খুব ছোট ছিলাম, ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আমরা এত গরিব। তবু কীভাবে এত সুখে আছি?” তখন তিনি বলেছিলেন, “দারিদ্র্য আমাদের সবচেয়ে সস্তা বিলাসিতা।” আমার বাবা খুব আশাবাদী ছিলেন। পরীক্ষায় কখনো ৬০-এর মধ্যে ৫৯ পেলেও বাবা বলেছেন, পরেরবার যেন আরও ভালো হয়। আর এটাই আমাকে অদম্য সাহস জোগায় জীবনের ব্যর্থতার সময়।’
গত বছর নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দুটি পুরোনো দুটি ছবি পোস্ট করেন। একটিতে সাদাকালো ক্যানভাসে, তখন তিনি বছর ২৬-এর যুবক। অন্যটিতে সাদা পাতায় ইংরেজি হরফে লেখা ঠিকানা। ছবিগুলোর সঙ্গে অনুপম লিখেছেন, ‘ছবিতে কাজ করতে ১৯৮১ সালের ৩ জুন মুম্বাই শহরে এসেছিলাম। ওই বছরের ১৫ জুন রাজশ্রী প্রোডাকশনসের অফিসে আমার এই পোর্টফোলিওটা রেখে এসেছিলাম। যদি আমাকে কোনো চরিত্রের জন্য বেছে নেওয়া হয়, সেই আশায় অপেক্ষা করেছি।’
অনুপম খের লিখেছেন, ‘মঞ্চ আমার প্রথম প্রেম, খুব ভালোবাসতাম। সারাক্ষণ অভিনয়ের কথা ভাবতাম। একদিন চণ্ডীগড়ে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়, সেখানে বলা ছিল বিজ্ঞাপনে অভিনয়ের জন্য লোক দরকার। কিন্তু হাতে টাকা নেই। মায়ের কাছে পিকনিকের কথা বলে ১০০ রুপি নিয়ে অডিশন দিতে গেলাম। পরে অবশ্য মা জানতে পেরেও কিছু বলেননি, তিনি মেনে নিয়েছিলেন।’
চণ্ডীগড়ে অভিনয়ের ক্লাসে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন অনুপম খের। সেখানে তিনি দুই বছর শিক্ষকতাও করেছিলেন। এ তথ্য দিয়ে অনুপম খের লিখেছেন, ‘একদিন জানতে পারি, মুম্বাইয়ে একটি নাটকের স্কুল আছে। সেখানে আবেদন করলে আমাকে ডাকা হলো। দেওয়া হলো একটি ছোট্ট ঘর। কিন্তু কোনো টাকাপয়সা কিছুই দিল না। বেশির ভাগ দিন খিদে পেটে ঘুমাতে হতো। পকেটে টাকা থাকত না। এমনও হয়েছে, কখনো সাগরপাড়ে সৈকতে বা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।’
কষ্টের এ সময় মা–বাবাকে জানাতে চাননি অনুপম খের। তাই তিনি ভাইকে লিখে পাঠালেন, ফিরতে চান তিনি। কিন্তু ভাই সায় দিলেন না। পাল্টা লিখলেন, ‘অনুপম, তুমি তো সেই মানুষ, যে পানির স্রোতে বেরিয়ে গেছ, সে আবার বৃষ্টির পানিতে ভয় পাচ্ছ! তুমি এভাবে কোনো দিনই বড় হতে পারবে না।’ কী করতে হবে বুঝে গেছেন অনুপম খের। বুঝে গেলেন মুম্বাই ছেড়ে ফেরা যাবে না।
এভাবে চলতে থাকে জীবন। এর মধ্যে একদিন সুযোগ চলে আসে। মহেশ ভাটের একটি ছবিতে কাজ পান অনুপম খের। কিছু টাকা আর থাকার জায়গাও মেলে। কিন্তু সে সুখ স্থায়ী হয়নি। একদিন তিনি জানতে পারেন, ওই চরিত্রের জন্য অন্য কাউকে নেওয়া হয়েছে। চলে গেলেন মহেশ ভাটের কাছে। সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, মহেশ ভাট তা স্বীকারও করেন। এবার ভেঙে পড়েন অনুপম খের।
এ প্রসঙ্গে অনুপম খের লিখলেন, ‘আমি সেই মুহূর্তে মুম্বাই ছেড়ে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়ই মহেশ ভাট বলেন, “তোমার মতো এই চরিত্রে কেউ এত ভালো অভিনয় করতে পারবে না। তাই তোমাকে ছাড়া এই ছবি বানাব না।” আমাকে ডাকা হলো এবং আমি জীবনে প্রথম সিনেমায় অভিনয় করি মহেশ ভাটের হাত ধরে।’
অনুপম খের বলেন, ‘আজ পর্যন্ত পাঁচ শর বেশি সিনেমা আমার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনো আমি ধন্যবাদ জানাই প্রতিদিন, সেই দিনগুলোকে, যখন শুধু ব্যর্থতাই ছিল। আমি ধন্যবাদ জানাই, সেসব মানুষকে, যাঁরা আমাকে অযোগ্য মনে করে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদেরও ধন্যবাদ জানাই, যাঁরা আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। এত কিছু না হলে আজকের আমি হতে পারতাম না। আর এটাই এখন বাস্তব।’ অনুপম খের জানিয়েছেন, প্রতিদিন কাজে যাওয়ার সময় নিজেকে বলেন অভিনয় সম্পর্কে কিছু জানেন না। ‘ওটাই একমাত্র উপায়। যদি নিজের জ্ঞান নিয়ে বড়াই করা শুরু করি, তাহলে নতুন আর কিছু শিখতে পারব না।’
সত্তর ছুঁয়েছেন, তবে কেউ তাঁর নামের পাশে ‘প্রবীণ’ শব্দটি ব্যবহার করলে, তিনি এটি মোটেও পছন্দ করেন না। বেশ কিছুদিন আগে নিজের ক্যারিয়ারের ৫৩২তম ছবি ‘কুছ খাট্টা হো যায়ে’ ট্রেলার লঞ্চ ইভেন্টের সময় তিনি তাঁর ৪০ বছরের ভ্রমণের কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। অনুপম খের বলেন, তিনি এই ইন্ডাস্ট্রিতে এত বছর দিলেও আজও তিনি একজন নতুন অভিনেতার মতো কাজ করতে পছন্দ করেন।
সেদিন অনুপম খের বলেছিলেন, ‘এটি আমার ৫৩২তম ছবি এবং ৪০ বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে, আমি বিশ্বাস করি যে আপনার একজন নবাগত হিসেবে কাজ করা উচিত। মানুষ আমাকে “প্রবীণ” বলে ডাকলে আমি ভয় পাই। তারা আপনাকে কীভাবে দেখে, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। কিন্তু আমি নিজেকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখতে চাই। অবশ্যই, আমি যে চলচ্চিত্রই করি না কেন, আমি প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি এবং ভালোবাসাও পেয়েছি। কিন্তু আগে আমি কোনো গন্তব্য ছাড়াই দ্রুত ছুটতাম। আর এখন আমি সঠিক পথে ধীরগতিতে এগোচ্ছি।’
তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের উত্থান-পতন সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘জীবনে তিক্ততার স্বাদ না পেলে প্রকৃত সুখ বুঝতে পারবেন না। গোটা ভ্রমণে যদি কোনো অসুবিধা না হয়, তবে তাকে আমরা যাত্রা বলতে পারি না। জীবনে অসুবিধা থাকা উচিত। উত্থান-পতন থাকা উচিত। তবেই আপনি জীবনকে উপভোগ করতে পারবেন। আমার সামনের পথটা যদি সরল ও সোজা হতো, তাহলে আমি তাতে হাঁটতে এতটা আনন্দ পেতাম না।’ অনুপম খেরের ভাষ্য, ‘আমি আমার সমস্যাগুলোকে স্বাগত জানাই। আমি আমার ব্যর্থতা এবং আমার খারাপ অভিজ্ঞতা থেকে শিখি। কিন্তু আমি সেগুলো মনে রাখি না। জীবনে অপেক্ষা করার মতো অনেক কিছুই আছে। আমি অনেক ভাগ্যবান। ১৯৮১ সালে আমি ৩৭ টাকা দিয়ে মুম্বাই এসেছি এবং আজ আমি আমার ৫৩২তম চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলছি। আমি আর কী চাইতে পারি জীবনে। সত্যিই আমি খুব খুশি।’ বর্তমানে এ অভিনেতার সম্পদের পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা।