দুই যুগের সংগীতজীবনে আসিফ আকবর তুমুল জনপ্রিয় একটি নাম। ২০০১ সালে প্রথম অ্যালবাম ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ প্রকাশের পর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দিন দিন আসিফের জনপ্রিয়তা যেন আরও বেড়েছে। সামর্থ্যবান পরিবারের সন্তান হয়েও শুধু গানের প্রতি ভালোবাসার কারণে আসিফকে ঢাকা শহরে অনেক কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করতে হয়েছে। অর্থাভাবেও দিন পার করেছেন। তবে এসব কথা পরিবারের কাউকে জানতে দিতেন না। আর তাই তো প্রথম অ্যালবাম প্রকাশের পর ঢাকা শহরের ফুটপাতে ফেরি করে বিক্রি করেছেন। কয়েক মাসের মধ্যে পান ফলাফল। গান সুপারহিট হওয়ায় অ্যালবামের চাহিদা বাড়তে থাকে। একটা সময় তো ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ অ্যালবাম রেকর্ড পরিমাণ বিক্রি হয়। আজ সেই অ্যালবাম এবং আসিফের ক্যারিয়ারের প্রথম দিকের সংগ্রামের গল্প শুনব।
দুই যুগ আগে ইথুন বাবুর কথা, সুর ও সংগীতে ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ অ্যালবাম আসিফের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপর দুই যুগে দুই ডজনের বেশি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। তবে প্রথম অ্যালবামের সাফল্যের পর কোনো কারণে ইথুন বাবুর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। এরপর একসঙ্গে কোনো অ্যালবামে দেখা যায়নি এই দুই তারকাকে। অভিমানের পাহাড় গলে পাঁচ বছর আগে ‘চুপচাপ কষ্টগুলো’ শিরোনামের একটি গান দিয়ে আবার ফেরেন এই দুই তারকা। এরপর জানান, তাঁরা দুজন নিয়মিত নতুন গান প্রকাশ করবেন। তাঁদের এই সম্পর্ক আগের মতোই দুর্দান্ত গতিতে এগোতে থাকবে।
সেদিন ‘চুপচাপ কষ্টগুলো’ গানের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আসিফ জানান, সাউন্ড ব্যবসা (কনসার্টে সাউন্ডবক্স সরবরাহ) করবেন বলে ১৯৯৭ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকায় আসেন আসিফ আকবর। একসময় সুরকার শওকত আলী ইমনের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর ইমনের স্টুডিওতে গানের ডেমো ভয়েস দিতেন।
সংগীতজীবনের শুরুর দিকের গল্পগুলো বলতে গিয়ে আসিফ বলেছিলেন, ‘আলী আকরাম শুভ (সংগীত পরিচালক) ভাইয়ের সঙ্গেও পরিচয় হয় ওখানে। “ক্ষ্যাপা বাসু” সিনেমার একটি গান গাই। এই গান শুনে ইথুন বাবু ভাই আমাকে ডাকলেন। তখন আমি মাস্টার্স পড়ছি। ঢাকা-কুমিল্লা যাওয়া-আসা করি। আমি দুই সন্তানের বাবা। ইথুন বাবু ভাই একদিন আমাকে ডেকে বললেন, “তোকে এমন গান দিলাম, কোনো দিন পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।” অসহায় অবস্থায় যখন জাহাজ সমুদ্রে ভাসে, তখন মানুষ বাঁচার জন্য খড়কুটো খোঁজে। আমারও তেমন হয়েছিল। আমি সিদ্ধান্ত ভুল নিইনি। “ও প্রিয়া তুমি কোথায়” গানটি গাইলাম। সেই সময় ইথুন বাবু ভাইয়ের সঙ্গে রাতদিন গান নিয়ে থেকেছি। ঘুম থেকে ওঠাতাম তাঁকে, আবার তাঁকে বাসায় দিয়ে আমি বাসায় ফিরতাম।’
ক্যারিয়ারের প্রথম দিককার কথা মনে করে আসিফ সেই অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ইথুন বাবু ভাই আর আমার রাত জাগার অভ্যাস। একদিন সারা রাত কাজ। হঠাৎ গভীর রাতে আমার স্ত্রীর ফোন, ছোট ছেলে রুদ্র অসুস্থ। অজ্ঞান হয়ে গেছে। বললাম, তুমি তো আছ। কোনোভাবে সামলে নাও, প্লিজ! হাসপাতালে নিয়ে যাও। ভোরে কাজ শেষে বাসায় ফিরি। ইথুন বাবু ভাই আমাকে গাড়িতে করে নিয়ে নামিয়ে দেন। আমি চলে যাচ্ছি, এই সময় আবার গাড়ি ঘুরিয়ে এসে বললেন, “তোর মন খারাপ কেন?” ইথুন বাবু ভাই আমাকে ৫০০ টাকা দিলেন। আমার পকেটে ছিল মাত্র ১০ টাকা। ইথুন বাবু ভাই বললেন, তুই রাতে আসবি। তোর টাকা আছে আমার কাছে। রাতে তোর টাকা দেওয়া হবে। ওই ৫০০ টাকায় আমি অ্যাংকর মিনিপ্যাক দুধ কিনেছিলাম ২০ টাকা করে। ৬ প্যাকেট দুধ কিনলাম। ৬ প্যাকেট দুধের সঙ্গে ছয়টা চামচ ফ্রি। (এই কথা বলার সময় আসিফ কাঁদতে থাকেন। এমন সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইথুন বাবু এগিয়ে এসে আসিফের পিঠে হাত রাখেন) আমার বাসার জন্য এক সেট চামচ হলো। এই রকম অসংখ্য গল্প আছে ইথুন বাবু ভাইয়ের সঙ্গে। ইথুন বাবু ভাই মেজাজি মানুষ, কিন্তু একদম শিশুর মতো মন। “ও প্রিয়া” যখন রিলিজ হবে, তখন সাউন্ডটেক হঠাৎ অ্যালবাম রিলিজ বন্ধ করে দেয়। ঈদে আর রিলিজ হবে না অ্যালবাম। আমার খুব মন খারাপ। আহমেদ রিজভী ভাই বললেন, এখন আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, এস ডি রুবেলদের মতো বড় শিল্পীদের অ্যালবাম বের হচ্ছে। তোমার অ্যালবামটি পরে বের হলেই ভালো। কারণ, তোমার অ্যালবাম হিট হলেও পুনরায় অর্ডার পাবে না। মন খারাপ আমার। কুমিল্লা চলে গেলাম। সেবার আমি ঈদ করিনি। তবে আমি কিন্তু সামর্থ্যবান পরিবারের সন্তান।’
কথায় কথায় সেদিন আসিফ বলেন, ‘কয়েক দিন পর ঢাকায় এলাম। ইথুন বাবু ভাই আমাকে ডাকলেন। ঢাকা শহরের গুলিস্তান থেকে মিরপুরের বিভিন্ন ফুটপাতে ক্যানভাসারদের কাছে ঘুরে ঘুরে অ্যালবাম দিলাম। গান বাজাতে অনুরোধ করলাম। রাজশাহী, রংপুর থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশ ঘুরেছি ইথুন বাবু ভাইয়ের গাড়ি চড়ে। তিন মাস পরে অ্যালবামের ফলাফল পেলাম।’ আসিফ সেদিনের অনুষ্ঠানে এ–ও বলেন, ‘আমার কষ্টের জীবন। পরিবার জানে না। পকেটে কোনো টাকা নেই। ঈদের সময় ইথুন বাবু ভাই তাঁর সন্তানদের জন্য কাপড় কিনতেন। সঙ্গে আমার আর আমার সন্তানদের জন্যও কিনতেন। এসব ঋণ শোধ হওয়ার নয়।’