ভোর থেকেই অর্পার ঘরে ভেসে আসছে সানাইয়ের সুর। বারান্দায় বসে চোখের জল ফেলছেন অর্পার মা। কিছুক্ষণ পর বোনের পাশে এসে বসেন অর্পার খালা। ভোরের বাতাসে দুজনের দীর্ঘশ্বাস ভেসে বেড়াতে থাকে।
আজ মারুফের বিয়ে। মারুফ কে, এ কথা যখন অর্পার সহকর্মী জানতে চান, তখন অর্পা বলে, ‘আমার জামাই!’ এভাবে শুরু থেকেই বিষাদের সুর ছড়াতে থাকে ‘নীল সুখ’। আর প্রথম দৃশ্য থেকেই দর্শক অপেক্ষা করতে থাকেন অর্পা আর মারুফের গল্প জানার জন্য।
একনজরে
ওয়েব ফিল্ম: ‘নীল সুখ’
জনরা: রোমান্টিক ড্রামা
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৬ মিনিট
স্ট্রিমিং: বিঞ্জ
পরিচালক: ভিকি জাহেদ
অভিনয়: মেহজাবীন চৌধুরী, ফররুখ আহমেদ রেহান
ভালোবাসার রং শুধু কি লাল হয়, নাকি বিষাদের নীলিমায় মুড়ে থাকে কোনো গল্প? ভিকি জাহেদ এবার এমন এক গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন, যেখানে ভালোবাসার অনেক রং। আর তা প্রকাশ করতে তিনি বেছে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানকে, যা কিনা ঋতুরাজ বসন্তের আবার ভালোবাসার আকুলতারও। ‘ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে’ আবহ সংগীতের সঙ্গে দর্শক যেন একাত্ম হতে থাকেন অতীত রোমন্থন করার জন্য। আবার শেষটাও যেন কোথাও গিয়ে মিলে যায় এই গানের কথার সঙ্গে।
অর্পার বয়ানে এগিয়ে যেতে থাকে ‘নীল সুখ’-এর গল্প। সেজেগুজে সে মারুফের বিয়ে খেতে এসেছে। অথচ এই মারুফের সঙ্গেই কিনা অর্পার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। মারুফকে সে ভালোবাসত সবার থেকে বেশি, সবচেয়ে বেশি। মারুফকে কেন্দ্রে রেখেই সে সাজিয়েছিল তার পৃথিবী। মারুফ যা যা করতে চাইত, যেভাবে চাইত, সেটাই ছিল অর্পার ধ্যানজ্ঞান। অন্যদিকে মারুফেরও সবচেয়ে ভরসার মানুষ ছিল অর্পা। নিজের মনের কথা প্রকাশ করা হোক কিংবা দুজন মিলে ক্রাইম করা, মারুফ আর অর্পা যেন ছিল দুজন দুজনার। দুই পরিবারের সম্মতিও ছিল এ সম্পর্কে। কিন্তু এত কিছুর পরও কী এমন হয়েছিল, যার জন্য অর্পাকে মেনে নিতে হয় এ পরিণতি? মারুফই–বা কেন অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাচ্ছে? সবই ভাগ্য, নাকি কোনো চক্রান্ত আছে এর পেছনে? জানতে হলে দেখতে হবে ১৮ ফেব্রুয়ারি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বিঞ্জে মুক্তি পাওয়া ভালোবাসা দিবসের বিশেষ ওয়েব ফিল্ম ‘নীল সুখ’।
নব্বইয়ের দশকের আমেজে এগিয়ে যায় নীল সুখ-এর গল্প। বড় উঠান কিংবা ছাদে ছোটদের খেলা, ভাইবোনেরা মিলে একসঙ্গে পড়ালেখা, ড্রয়িংরুমের টিভিতে সবাই মিলে সিনেমা দেখা, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়া, সবাই মিলে শাড়ি পরা কিংবা জঙ্গলে চাদর পেতে পিকনিক—সবকিছুতে ফুটে ওঠে একটুকরো নব্বই। থ্রিলার আর ডার্ক গল্পের বাইরে গিয়ে ভিকি যেন এবার সত্যিই রোমান্টিক গল্প বলে গেলেন। ছিমছাম, পরিমিত প্রতিটি দৃশ্য যেন মনে করিয়ে দিচ্ছিল প্রথম প্রেমে পড়ার মুহূর্তগুলোকে। প্রতিটি দৃশ্য এত সুন্দর ছিল যে ফিল্মটি শেষ করার পরও চোখে ভাসছিল বারবার।
নির্মাতা ভিকি সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর নাটক, সিনেমা বা সিরিজে তাই উঠে আসে দেশ-বিদেশের নির্মাতাদের কথা। এবার যেমন পিকনিকের দৃশ্যটি দিয়ে তিনি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’কে মনে করিয়েছেন, আরেকটি দৃশ্যে আছে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ প্রসঙ্গ। বস্তুত, এ সিনেমায় অন্যতম সেরা দুই ভারতীয় নির্মাতা সত্যজিৎ রায় ও শেখর কাপুরকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছেন।
অর্পা হিসেবে মেহজাবীন চৌধুরী দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। প্রেমে পড়া এক উচ্ছল কিশোরী হোক কিংবা বদলে যাওয়া এক তন্বী—মেহজাবীনের অভিনয় ছিল গল্পের প্রাণ।
তাঁর প্রেমে পড়া যেমন মনে করিয়ে দিচ্ছিল প্রথম প্রেমে পড়ার মুহূর্তগুলোকে, তেমনি কষ্টের দৃশ্যে চোখের কোণে জমছিল জল। উচ্ছ্বাস, বিষাদ আর প্রতিশোধের মিলিত রূপ যেন তাঁর চরিত্রটি। এমন জটিল এক চরিত্রে আবার নিজের ছাপ রেখেছেন অভিনেত্রী। গত বছরটা শেষ করেছিলেন ‘মালতী’ হয়ে, ‘অর্পা’ দিয়ে নতুন বছরটাও দুর্দান্ত শুরু করলেন।
প্রতিষ্ঠিত তারকার বিপরীতে তুলনামূলকভাবে নতুনদের সুযোগ দেন ভিকি। ‘আমি কী তুমি’-তে এর আগে মেহজাবীনের বিপরীতে জোনায়েদ বোগদাদীকে নিয়েছিলেন, এবার নিলেন রেহানকে। তিনি চেষ্টা করেছেন মেহজাবীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে।
সাধারণ দৃশ্যগুলোতে তিনি ভালো করেছেন, তবে আবেগের দৃশ্যগুলোতে আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। পার্শ্বচরিত্রে যাঁরা ছিলেন, তারা চলনসই। সিনেমার একটা বড় দুর্বলতা, অর্পার সঙ্গে তাঁর পরিবারের সম্পর্কটা ঠিকঠাক গড়ে তোলা হয়নি। তাই পারিবারিক বিপর্যয়ের সময় অর্পার আবেগ ঠিক জমে না।
অনেকেরই মনে হতে পারে, এটি ঠিক ভিকি–সুলভ কাজ নয়। শুরু থেকে রসায়নবিদ্যার এনসাইক্লোপিডিয়া খুলে বসাও বাড়াবাড়ি লাগতে পারে। তবে ভিকি নিজের সিগনেচার জমিয়ে রেখেছিলেন শেষ পাতের জন্য! রোমান্টিক গল্প হলেও নীল সুখ-এর শেষটা পুরোপুরি চমকে দিতে বাধ্য।
তবে সেটা কতটা নৈতিক, সে প্রশ্ন থেকে যায়। স্পয়লার না দিয়ে দৃশ্যটি নিয়ে আলোচনাও করা যাবে না। মাঝখানে বেশ কয়েকটি কাজে ভিকির ছাপ সেভাবে পাওয়া যায়নি, নীল সুখ দিয়ে হয়তো ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিলেন তিনি।