তরুণ অভিনেতা শাহবাজ সানী মারা যাওয়ায় তাঁর বন্ধু ও সহকর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন, সানী মেধাবী অভিনয়শিল্পী হলেও সিন্ডিকেটের শিকার তিনি। দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করেও অনেকের সঙ্গে কাজ করতে পারছিলেন না। বাদও পড়ছিলেন কাজ থেকে। কাজ নিয়ে অভিমান ছিল তাঁর। যে কারণে কেউ কেউ এই অভিনেতার প্রয়াণে নাট্যাঙ্গনে সিন্ডিকেটকে নতুন করে সামনে আনছেন।
একসময় ইমরান রবিনের নাটকে অভিনয় করেছেন শাহবাজ সানী। সেই পরিচালক সানীর প্রয়াণে অভিমান করে লিখেছেন, ‘সানীর অকাল মৃত্যু আবারও প্রমাণ করল আমাদের সময় যখন তখন শেষ হয়ে যাবে। কী হবে এত সিন্ডিকেট, অহংকার আর অভিশাপ দিয়ে…সময় তো অল্প।’
আরেক পরিচালক আমিনুল শিকদার লিখেছেন, ‘মানুষ মারা গেলে কদর বেড়ে যায়।’ একই কথা লিখেছেন আরেক অভিনেতা সিয়াম নাসির। তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ মারা গেলে ভালোবাসা উথলাইয়া পড়ে। বেঁচে থাকতে খবর লয় না।’
পরিচালক ইমরান রবিন বলেন, ‘এই সময়ে চরিত্র অভিনেতাই নয়, পরিচালকসহ সবার জন্য সিন্ডিকেট প্রকট আকার ধারণ করছে। এই সিন্ডিকেটে একজনের হয়ে কাজ করলে অন্যরা তাকে নিয়ে কাজ করতে চাইবে না। সামনে এক কথা বলে পেছনে আরেক কথা বলে বেশির ভাগ শিল্পী। এখন সবাই সানীর প্রশংসা করছে, বলছে ভালো অভিনেতা ছিল। সানী চাইত সবার সঙ্গেই কাজ করতে। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে সেই সুযোগ অনেক কম পেয়েছে। তার জন্য যদি কেউ নিঃস্বার্থভাবে কিছু করত, তাহলে সে মানসিকভাবে আরও ভালো থাকত।’
মোহন আহমেদের নাটকে অভিনয় করেছিলেন সানী। পরবর্তী সময়ে এই পরিচালকের বেশ কিছু কাজ করেছেন। মোহন বলেন, ‘সানীর সঙ্গে বেশ কিছুদিন আগেই কথা হয়। তখন সে জানিয়েছিল, এখন প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছে। তার প্রথম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা নাটকের নাম বলল, “জামাইয়ের মাথা গরম”। জানাল, এটাই ছিল ওর প্রথম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা। এটাই একজন অভিনেতার প্রধান চরিত্রে শেষ কাজ মানতে কষ্ট হচ্ছে।’
নাম প্রকাশ না করা শর্তে সানীর এক সহকর্মী জানান, অনেকের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সানী কখনোই কোনো গ্রুপ হয়ে কাজ করেননি। তিনি বলেন, ‘নাটকে তার চেষ্টা ছিল। একটা জায়গায়ও তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু ভালো প্রস্তাব পাচ্ছিল না। দেখা যেত, ইচ্ছা করে অনেকেই দু–একটি সিন ধরায় দিত। ছোট চরিত্র না করলে সম্পর্ক খারাপ হতো। সে কারণ কিছু কাজ করত। আবার কখনো হঠাৎ কাজ থেকে বাদ দিত। কদিন আগে অভিনয়ের পাশাপাশি খিলক্ষেতে রেস্টুরেন্ট দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিল। হতাশা, অভিমানেই ছেলেটা চলে গেল।’
‘জামাইয়ের মাথা গরম’ নাটকটি প্রচারিত হয় কথা ছবি ইউটিউব চ্যানেলে। এ চ্যানেলের স্বত্বাধিকারী রাকিব চাকলাদার ও চ্যানেলটি নাট্য নির্মাতা প্রিন্স রোমান গতকাল ঘটনাস্থলে ছিলেন। তাঁরাই প্রথম প্রধান চরিত্রে সানীকে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। প্রিন্স রোমান বলেন, ‘দিয়াবাড়ির উত্তরা উত্তরের মেট্রোরেল স্টেশনের পাশে আমরা তিনটা নাটক নিয়ে কথা বলছিলাম সানীর সঙ্গে। তখন রাত সোয়া ১০টা বাজে। এর মধ্যে হঠাৎ সানী প্রচণ্ড কাশতে থাকে। পাশাপাশি ঠান্ডায় সর্দি ছিল। কাশি বেশি হলে সে একসময় আমাদের কাছ থেকে উঠে পাশে যায়। তখনো কাশছিল। সে সময়েই হঠাৎ দেখি, সে পড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাই। চিকিৎসক দেখার পর জানান, পালস কাজ করছে না। আইসিইউতে রাখা হয়। অবস্থা আরও খারাপ হলে অন্য একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সিসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পর্যবেক্ষণে রাখার পর রাত সাড়ে তিনটার দিকে চিকিৎসক জানান, সানী মারা গিয়েছে।’
চ্যানেলের স্বত্বাধিকারী রাকিব চাকলাদার বলেন, ‘সানী ভালো অভিনেতা ছিল, কিন্তু কেউই তাকে প্রধান চরিত্রে সুযোগ দেয়নি। সে নাট্যাঙ্গনে পলিটিকসের শিকার। তাকে সাপোর্ট দিতেই আমরা একটার পর আরও তিনটা নাটকের নিয়ে কাল কথা বলছিলাম। সেই মিটিংই যে সানীর জীবনের শেষ মিটিং হবে, সেটা আমাদের কষ্ট দিয়েছে।’ তিনি আরও জানান, সারা রাত তাঁরা হাসপাতালে ছিলেন। সকালে সানীকে হাসপাতালে দেখতে আসেন অভিনয়শিল্পী তৌসিফ মাহবুব, খায়রুল বাসার, ইয়াশ রোহান, পরিচালক ইমরাউল রাফাত, রাফাত মজুমদার, এস আর মজুমদারসহ অনেকে।
সানীর কাছের আরেক পরিচালক আরমান রহমান জানান, অভিনেতা হওয়ার জন্য লক্ষ্মীপুর থেকে একা ঢাকায় এসেছিলেন সানী। একটা সময় দিনের পর দিন খেয়ে না–খেয়ে দিন কেটেছে। কিছুটা পরিচিতি পাওয়ার পরও দিন কেটেছে প্রোডাকশন হাউসে ঘুরে ঘুরে। সানীর আদর্শ ছিল মোশাররফ করিম। তিনি নায়ক হতে চাইতেন না, চাইতেন চরিত্রাভিনেতা হতে। ‘আমাদের দেশে প্রতিভার কোনো কদর নাই। কাজের জন্য অনেক জায়গায় দৌড়ায়ছে কিন্তু সাড়া পায়নি। অভিনেতা হিসেবে সে ভালো ছিল। একটু একটু করে যখন ভালো থাকার কথা, তখনই সে বিদায় নিল।’ বলেন আরমান।
দীর্ঘ সময় ধরে পরিচালক ইমরাউল রাফাত সানীকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। একসময় সানী তাঁর অফিসেও থাকতেন। ইমরাউল রাফাত ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘সানীকে স্ট্রাগলার অভিনেতা হিসেবে অবহিত করে কেউ কিছু লিখবেন না। অভিনেতা হিসেবে সে তার জাত অনেক আগেই প্রমাণ করেছে। সে রাজার মতোই বেঁচে ছিল। রাজার মতোই মারা গিয়েছে। সে সবার ভালোবাসা নিয়ে গেছে। একজন চরিত্র অভিনেতা হিসেবে তার কোনো আফসোস ছিল না। সে অভিনয়টা ধারণ করত, প্যাশন হিসেবে নিত। কারও দয়ায়, চাটুকারিতা করে সে অভিনেতা হয় নাই। সস্তা ফ্রেম দিয়ে সেলিব্রেটি হতে চায় নাই। একজন অভিনেতা কোনো দিন মরে না। বেঁচে থাকে সবার মাঝে।’
সানীর মা অসুস্থ। সানীরা দুই ভাই–বোন। আজ বাদ জোহর পর লক্ষ্মীপুরে গ্রামের বাড়িতে সানীকে তাঁর বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে।