দ্যা নিউ ভিশন

ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫ ০৪:৫৬

‘বারোটা ছোট্ট বুলেট তোর পিঠ ফুঁড়ে বারো দিকে বেরিয়ে গেছে’

‘ঊনমানুষ’ নাটকের দৃশ্য।

১২টি গুলিতে বুক ঝাঁজরা একটি লাশ পড়ে আছে। তার সৎকার হয়নি। পচে ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে। শেয়াল-শকুন-মাছিরা এই গন্ধে এসে নাচানাচি করছে। মানুষকে ব্যঙ্গ করে তারা বলছে, ‘আমাদের হাতে কাঁটাচামচ নাই কিন্তু আমাদের হাতে নখ আছে। আমাদের টাই নাই কিন্তু আমাদের গলায় খাই খাই সুড়সুড়ি আছে।’
লাশের সৎকার হয়নি। সে তাদের কাছে মিনতি করে বলছে, ‘আমার এখনো সৎকার হয়নি। তোরা এভাবে একটা মানুষ খেতে পারিস না। ইঁদুর খা, গরু খা, উট খা, ছাগল খা, যা পাস তাই খা, আমারে কেন?’ উত্তরে ওরা লাশকে বলছে, ‘তুই কি সৎ যে তোর সৎকার হবে? তুই কোন সভ্য দেশের সন্তান? তোরা সন্তান না শয়তান, তোরা সবগুলো শয়তান। দুপায়া বানর।’

‘ঊনমানুষ’ নাটকে বিদ্রূপাত্মক এই সংলাপে বিপন্ন মানবতা ও মানবসভ্যতার প্রতি তীব্র শ্লেষ দর্শকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমরা এখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি। আমরা আসলে অসম্পূর্ণ মানুষ। এখানেই ‘ঊনমানুষ’ নামকরণের সার্থকতা।
জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে সব জেলায় প্রযোজনাকেন্দ্রিক নাট্য কর্মশালা ও শহীদ মুনীর চৌধুরীকে স্মরণ করে প্রথমবারের মতো মুনীর চৌধুরী জাতীয় নাট্যোৎসবে গতকাল রোববার রাতে রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে।

নওগাঁ জেলা শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনায় নির্মিত নাটকটির গল্পভাবনা ও পাণ্ডুলিপি রচনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী তামান্না জাহান নেলী। নির্দেশনা দিয়েছেন একই বিভাগের অধ্যাপক আমির জামান। নাটকটি নির্মাণে বাংলা বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির পাশাপাশি ব্রেখটের নাট্যরীতি ও মেয়ারহোল্ডের অভিনয়শৈলী অনুসৃত হয়েছে।

নাটকে দেখা যায়, পড়ে থাকা লাশের কাছে আসে তার মা, বাবা ও সাবেক প্রেমিকা। তাদের সংলাপের ভেতরে দিয়েও একই হাহাকার উঠে আসে, যা সমকালীন বিশ্বের যুদ্ধবিগ্রহ, অর্থনৈতিক মন্দা, রাষ্ট্রীয় শোষণ-নিপীড়ন, রাজনৈতিক সহিংসতাসহ বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে মৃত্যুর মিছিলের অসীম কান্নার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে  গেছে। আঘাতে অপমানে ভূলুণ্ঠিত মানবতার কথাই ঘুরেফিরে এসেছে।

মা বলেন, ‘এখানে থামলি হবে না রে বাজান। নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা …তোর কত খামতি।…গর্ভে রাখিছিলাম তোরে, বাইরে এনে যখন পৃথিবীর গর্তে তোরে দিলাম ছেড়ে, তারপর আর তোর কোনে গতি হলো না আজও। যেমন করে গতি হয়নি তোর বাপের, দাদার, চাচার, ভাইয়ের, বোনের, তোর গাঁয়ের আর দ্যাশের বেবাক মানুষের।’

ছেলে (লাশ) তখন হতাশা আর বঞ্চনার ক্ষোভে বলে ওঠে, ‘আমার তো কোনো জননী নাই। আমি তো মানুষই নই। প্রাণী, প্রাণী। না না বৃক্ষ। আমি তো মাটি ফুঁড়ে জন্মেছিলাম, মাটিতেই পড়ে আছি আবার। ঘুম ভাঙালে কেনে?’
মা বলেন, ‘১২টা ছোট্ট বুলেট তোর পিঠ ফুঁড়ে ঢুকে বুক ফেড়ে ১২ দিকে বেরিয়ে গেছে। তুই অহন বারোফুটোর বারোয়ারি। তুই সামনে হয়তো দেখাইছিলি বুকচেতা বড়াই, কিন্তু পেছনে পেছনে তোরে দেখতিছিল মরণ।’ ছেলে বলে, ‘আমি ক্যান মরছি? কও?’
মা বলেন, ‘তা তো জানি নে বাপ। ধর, জন্মিছিস, তাই মরছিস। জন্মালি মরতি অয়। ঘোড়া মরে, হাতি মরে, বাঘ মরে, পিপীলিকা মরে, হরিণ মরে, মশা মরে, টিয়া মরে, মুরগি মরে।’

এসবের জন্য ছেলে মাকে দায়ী করে বলে, ‘আমার জন্য এত্ত বড় পৃথিবীর কোনো জমিন নাই। আমি কি শেয়াল শকুনের প্যাটেই থাকমু? আসার আগে তর প্যাটে ছিলাম, শ্যাষে যাবো শেয়াল শকুনের প্যাটে। ক্যান আনছিলি দুনিয়ায়? তুইও একটা শেয়াল, তুইও একটা শকুন। তোরা সক্কলে পশু।’

মা বলেন, ‘আমি শেয়াল, আমি শকুন। কিন্তুক আমার পিতিতে বুদ্ধিও নাই ধারালো নখও নাই।’ তীব্র শ্লেষাত্মক এই সংলাপ নাটকের দর্শকদের মর্মে চরম আঘাত হানে। ৫০ মিনিটের এই নাটকে পিনপতন নীরবতায় তাঁরা আসনের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকেন। তাই বলে, নাটকের বাঁকে বাঁকে দর্শক করতালি দিয়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়ার জানান দিতে ভুল করেননি।

একইভাবে এই লাশের প্রাক্তন প্রেমিকা আসে। ঘুমন্ত লাশকে জাগিয়ে তোলে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে লাশটি দণ্ডায়মান প্রেমিকার হাঁটু জড়িয়ে ধরে। প্রেমিকা বলে, ‘ছাড়ো। নেকামির সুর ঘেন্না লাগে। বিয়ে করার মুরোদ নাই। পালানোরও সাহস নাই। আইছে নাকি কাঁনতে।’

এবার লাশ তার বুলেটে ঝাঁজরা বুক দেখায়। প্রেমিকা তার রক্তমাখা বুকে হাত বুলায়। জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে কাঁদে। একপর্যায়ে বলে, ‘আমার মেহেদির দাগ অহনও যেন শুকাই নাই। আর তোমার রক্তের দাগ শুকাই গেল! তারা দুজনে ঘনিষ্ঠ হয়। এমন সময় মেয়েটির বর এসে বলে, ‘ছিহ সোনা। ছিহ। বিয়ের পর ইটিশপিটিশ করতে নেই। পিছুটান খুব ভ্যাজাল জিনিস।…আয় দুষ্টু।’ এই দৃশ্যে দর্শক করতালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে ভুল করেননি।’

শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, লাশটি যেন গাছের মতো পড়ে আছে। তাকে ঘিরে মাছি-শিয়াল-শুকুনের দল চুপটি করে বসে মিহি সুরে গান গায়। ‘তোমাদের মগজে অসুখ করেছে মানুষ। আমাদের অসুখ করেছে পেটে।’ এরপর তাকে ঘিরে ধরে নৃত্যগীতে বলে, ‘বিজনে নির্জনে ডুবে ডুবে খাও কোন ঘাটের পানি, তোমার মানবীয় মুখে দানবীয় হাসির মানে আমরা জানি।’

নাটকজুড়ে এভাবেই ক্ষমতাধর মানুষের সবচেয়ে নির্লজ্জ ও জঘন্যতম অপরাধের বিরুদ্ধে শিল্প-অভিযাত্রা শাণিত হয়েছে।

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ