দ্যা নিউ ভিশন

এপ্রিল ১৮, ২০২৫ ১১:০৬

যে গান যুদ্ধদিনের কথা বলে

‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানের সুরস্রষ্টা আনোয়ার পারভেজ। গানটি লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার

১৬ ডিসেম্বর সকাল। সংগীতশিল্পী সুজেয় শ্যাম বেতারকেন্দ্রে যাওয়ার পরপরই বেতারের কর্মকর্তারা তাঁকে ডেকে নিলেন। কারণ একটাই, বিজয়ের গান করতে হবে। কিন্তু নতুন গান কোথায়? প্রশ্ন করলে কর্মকর্তারা তাঁকে গীতিকার শহীদুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করতে বললেন।

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ তখনো সম্পন্ন হয়নি। তবে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। এর আগে ভোর পাঁচটা থেকে পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধবিরতি শুরু করেছে। চারদিকে আনন্দের ঐকতান। স্বাধীনতার সূর্য ফেটে পড়ছে চারদিকে। নির্দেশনা এসেছে বিজয়ের গান করতে হবে। কর্মকর্তাদের পরামর্শমতো শহীদুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করলেন শ্যাম। হৃদয় হিল্লোলে মা আর প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসার উচ্চারণে মুহূর্তের মধ্যে গানের শুরুর চার লাইন লিখে ফেললেন শহীদুল ইসলাম। ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ/ খুশির হাওয়া ঐ উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে/ মুক্তির আলো ঐ ঝরছে’।

এখন সুর করতে হলে হারমোনিয়ামের দরকার। কিন্তু হারমোনিয়াম অপ্রতুল, ভাগে পাওয়া যাচ্ছে না। মুখে মুখে সুর করার চেষ্টা করতে করতে হারমোনিয়ামও মিলে গেল।

সুরে সুরে, হারমোনিয়ামে বিজয়ের গানের প্রথম চার লাইন উচ্চারিত হলো। পরপর শহীদুল ইসলামও অন্তরা লিখে দিলেন। সুরও সম্পন্ন হলো। গাওয়ার অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু গানে লিড দেবেন কে? ভাবতে ভাবতে অজিত রায়ের নাম মাথায় আসতেই শ্যাম তাঁর কাছে ছুটে গেলেন। বললেন, ‘আপনাকে লিড দিতে হবে’। অজিত রায় রাজি হলেন। মাত্র ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে সুর, মহড়া সম্পন্ন হলো। তারপর হলো রেকর্ড।
১৬ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ঘোষণা হওয়ার পরপরই রেডিওতে গানটি বেজে ওঠে। এটি ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত শেষ গান।
‘জয় বাংলা বাংলার জয়/ হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়’ মহান মুক্তিযুদ্ধে গানটি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। গাজী মাজহারুল ইসলামের লেখা এ গানটির সুর করেছেন আনোয়ার পারভেজ। এই গান তৈরির পেছনেও আছে গল্প।
আনোয়ার পারভেজ সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করবেন। গাজী মাজহারুল ইসলাম গান লিখলেন। কিন্তু সুর করার জন্য বসার জায়গা বের করতে হিমশিম খাচ্ছেন দুজনে। শেষমেশ বর্তমান সংসদ ভবনের উল্টো দিকের একটা গলির ভেতর রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন দাঁড়িয়েই গানটি করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। আনোয়ার পারভেজ মাজহারুল ইসলামকে বললেন, ‘দোস্ত গানটা বের কর।’ ‘আরেকবার একটু কলম চালাতে পারলে হতো’ বললেন মাজহারুল ইসলাম।

কিন্তু হাতে সময় কম, তাই আনোয়ার পারভেজ কিছু না বলে তার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়তেই অবাক হয়ে গেলেন। ‘কী অসাধারণ কথার গান’ ধমক দিয়ে মাজহারুল ইসলামকে বললেন, ‘এর আর বদলাবি কী? আয়, সুর করে ফেলি’। মাত্র ২০ মিনিটে গানটির কম্পোজিশন করেন দুজনে। পরে ইন্দিরা রোডের ঢাকা রেকর্ডিং স্টুডিওতে গানটি তাঁরা রেকর্ড করেছিলেন।

‘সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে’ বিবিসির শ্রোতা জরিপে ১২তম স্থানে থাকা এ গানটির রচয়িতা ফজল-এ-খোদা। পত্রপত্রিকার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গানটি লেখা হয়। নিজের ডায়েরিতে গানটি লিখে রেখেছিলেন  গীতিকবি। ডায়েরি থেকে গানটি নিয়ে প্রথম সুর করার চেষ্টা করেছিলেন কণ্ঠশিল্পী বশীর আহমেদ। কিন্তু নানা কারণে রেকর্ড করে উঠতে পারেননি। পরে ১৯৭১ সালে শিল্পী আবদুল জব্বার গীতিকারের কাছ থেকে গানটি নিয়ে সুর করেন এবং নিজেই গানটি কণ্ঠে তুলে নেন। মুক্তিযুদ্ধে গানটি মানুষের হৃদয়ে আবেদন তৈরি করেছিল। আজও দেশপ্রেমে, ভালোবেসে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে মানুষ গানটি গেয়ে ওঠেন।
‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ ও ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যাঁরা’ গান দুটিও স্থান করে নিয়েছিল বিবিসির শ্রোতা জরিপের শ্রেষ্ঠ ২০ গানের তালিকায়। দুটি গানেরই গীতিকার গোবিন্দ হালদার।

বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যাঁরা’ গানটি বাংলাদেশ বেতারে প্রচার হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। গানটির সুরকার আপেল মাহমুদ। রেডিওতে রেকর্ড করা গানটিতে প্রথম কণ্ঠ দিয়েছিলেন শিল্পী স্বপ্না রায়। প্রচণ্ড জ্বর গায়ে নিয়েও গানে কণ্ঠ দিতে পিছিয়ে যাননি শিল্পী। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পাওয়ার পরপরই গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল।

‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানটির গল্পও আকর্ষণীয়। ওই সময় শিল্পীরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আসতেন। সবার চোখে এক স্বপ্ন, এক লক্ষ্য। সবাই চান মুক্তি, চান স্বাধীনতা। আর এখানেই গোবিন্দ হালদারের সঙ্গে আপেল মাহমুদের একদিন দেখা হয়। পরিচয়পর্ব শেষে গোবিন্দ হালদার তাঁর গানের পাণ্ডুলিপি তুলে দেন তাঁর হাতে। অন্যান্য গানের মতো ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানের কথা পড়েও অভিভূত হয়েছিলেন আপেল মাহমুদ। একটি গানে মানুষের হৃদয়ের সারকথা উঠে এসেছে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কালক্ষেপণ না করেই বসেছিলেন গানের সুর করতে। জুন মাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল।

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ

ছাত্রদলের অনুষ্ঠানে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি, ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার আশা

ছাত্রশিবির, ছাত্রদলসহ যাঁরা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন, তাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী