প্রথম দিন শুটিং ফ্লোরে পা রেখেই উত্তমকুমার আনন্দে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। ‘মায়াডোর’ সিনেমার শুটিংয়ের জন্য তৈরি ঝকঝকে বিয়েবাড়ির সেট আর ইউনিটের কর্মব্যস্ততা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। সেই দিন প্রথম দেখায় পরিচালক বলেছিলেন, ‘ওকে দিয়ে মনে হয় কাজ হবে। ওকে মেকআপ রুমে নিয়ে যাও।’ সিনেমার জন্য নবাগত উত্তমকুমারকে বর সাজিয়ে দেওয়া হয়, আর শুরু হয় তাঁর অভিনয়, যার জন্য তাঁকে দৈনিক ৫ সিকি পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছিল। চাকরির পাশাপাশি এই কাজ মন্দ ছিল না। ক্যারিয়ারের শুরুতেই সাফল্যের স্বাদ পেলেও পরে তাঁকে কেরিয়ার ধরে রাখতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, এমনকি সিনেমা ছাড়ার কথাও ভাবতে হয়েছিল।
কয়েক দিন ধরে চলল সেই সিনেমার শুটিং। শুটিং একসময় উত্তমকুমারের কাছে নেশার মতো হয়ে উঠেছিল, কিন্তু বড় পর্দায় নিজেকে দেখার সুযোগ পাননি। সিনেমাটি মুক্তি না পাওয়ায় হতাশ হতে হয় তাঁকে। এরপর পোর্ট অফিসের চাকরিতে মনোনিবেশ করেন, পাশাপাশি টুকটাক অভিনয়ের খোঁজ করতে থাকেন। ভারত তখন স্বাধীনতার আন্দোলনে উত্তাল; হরতাল, দাঙ্গায় অস্থির কলকাতা। সিনেমা-নাটক সব বন্ধ হয়ে যায়। দেশভাগের পর অনেক দিন পর্যন্ত তিনি সিনেমার কথা আর মুখেও আনেননি। নানা বাধায় কিছুটা দমে গেলেও ২৭ টাকা পারিশ্রমিকে ‘দৃষ্টিদান’ সিনেমায় কাজ করেন, যদিও হাতে পান মাত্র সাড়ে তেরো টাকা। এসবের পরেও নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখা তাঁর কাছে বড় আনন্দের বিষয় ছিল। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি, সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
ক্যারিয়ার শুরুর পর ‘কামনা’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘মর্যাদা’সহ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পান উত্তমকুমার। সিনেমাগুলো মুক্তিও পায়, কিন্তু কোনোটিই সাফল্য আনতে পারেনি। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। শুটিংয়ে ব্যর্থতা নিয়ে নানা কথা শুনেও চুপ থাকতেন। কেউ কেউ মুখের ওপর বলে দিতেন, ‘তাঁকে দিয়ে হবে না।’ কিন্তু উত্তম এসব কথায় দমে যাননি, বরং সবার সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করতেন। এমনকি অনেককে সিগারেট, পারিশ্রমিক থেকে কমিশন দিয়ে নিজের দিকে রাখার চেষ্টা করতেন।
তবে কঠিন সময় আসে ১৯৫১ সালে। সেবছর তাঁর জীবন যেন দোলাচলের মধ্যে পড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তাঁকে কান্নাও করতে হয়েছিল। উত্তমকুমার তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার আমি’তে উল্লেখ করেছেন, ‘অশান্তির বিষাক্ত পোকাগুলো যেন আমার ভেতরে কিলবিল করছিল। এভাবে একটার পরে একটা ছবি যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে আমারও যে ব্যর্থতা!’ সেই বছর ‘মর্যাদা’ সিনেমাও ফ্লপ হয়। ভীষণ লজ্জায় ঘেরা উত্তমকুমার তখন নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। অনেক বন্ধুও তাঁকে অপমান করতে থাকেন। তাঁরা বলতেন, ‘তুই ফ্লপ মাস্টার জেনারেল।’
১৯৫১ সালে উত্তমকুমারের জন্য কঠিন সময় ছিল। ‘সহযাত্রী’ সিনেমায় অভিনয় করেও ব্যর্থ হন। এ সময়ে তাঁর নাম পরিবর্তন করে উত্তমকুমার রাখা হয়, কিন্তু সফলতা আসেনি। সিনেমাটি মুক্তি পেলেও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। পরপর তিনটি সিনেমা ব্যর্থ হওয়ায় এবার উত্তমকুমার অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন প্রায় ত্যাগ করেন। এমন পরিস্থিতিতে তিনি সিনেমা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৫১ সাল যেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল। একের পর এক ব্যর্থতায় তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। তখন তিনি চোখে অন্ধকার দেখছিলেন। পরবর্তী বছরেও ভাগ্য সহায় হয়নি। কিন্তু ‘বসু পরিবার’ সিনেমা তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। তারপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ব্যর্থতা কাটিয়ে তিনি পরিণত হন কালজয়ী মহানায়কে। আজ এই মহানায়কের ৯৯তম জন্মদিন, যিনি ১৯২৬ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।