**বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও ‘এসটিইএম’ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা**
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও অনেকাংশে পুরনো ধারনা এবং কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল, যা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশে এক বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শিক্ষাব্যবস্থা মূলত শিল্পবিপ্লবের সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যখন শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা। কিন্তু আধুনিক যুগের প্রেক্ষাপটে এই পদ্ধতি আর কার্যকর নয়। বর্তমান সমাজের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে কৌতূহল, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা গড়ে তোলা, যাতে তারা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে।
প্রতিটি শিক্ষার্থী আলাদা। তাদের শেখার ধরণ, শিখনক্ষমতা ও দক্ষতা ভিন্ন ভিন্ন। তাই একক মানসম্মত পরীক্ষা এবং নির্দিষ্ট সিলেবাস সবার জন্য কার্যকরী হতে পারে না। বর্তমান পরীক্ষামুখী শিক্ষা ও শিখন পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা এবং বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে সাহায্য করছে না। বরং একটি প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন, যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য মুখস্থ করবে না, বরং বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে শিখবে।
**শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন ও এসটিইএম শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা**
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা আবশ্যক। পরীক্ষামুখী শিক্ষা এবং একাধিক মানদণ্ডের পরিবর্তে শিক্ষাকে প্রকল্পভিত্তিক ও কার্যকরী করতে হবে। শিক্ষার্থীদের এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা উদ্ভাবনী চিন্তা বিকাশ করতে পারে, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারে এবং বাস্তব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যখন একজন শিক্ষার্থী কোনো বিশেষ বিষয়ে আগ্রহী হয়, তখন তার সেই বিষয়ে গভীরভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
এসটিইএম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, গণিত) শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা উন্নত করা সম্ভব। এসটিইএম শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের এই বিষয়গুলোতে দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। কোডিং, রোবোটিক্স এবং প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান করতে শেখে।
**শিক্ষকদের ভূমিকা**
এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা কার্যকর করতে শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের শুধু পাঠ্যপুস্তক শিক্ষা দেওয়া নয়, বরং শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত প্রতিভা ও দক্ষতাকে মূল্যায়ন করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী শেখানোর পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া, শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষাও দিতে হবে, যাতে তারা একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
**এসটিইএম শিক্ষার বাস্তবায়ন**
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে এসটিইএম শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এসটিইএম এবং তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক বিষয়গুলো পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের চাকরির বাজারে ভালোভাবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারবে, এবং তারা সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করবে।
এসটিইএম শিক্ষার বাস্তবায়নের জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:
১. **প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা:** শিক্ষার্থীদের প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে, যাতে তারা বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধান করতে শেখে এবং উদ্ভাবনী চিন্তা বিকাশ করে।
২. **কোডিং ও প্রোগ্রামিং শেখানো:** শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক স্তর থেকেই কোডিং ও প্রোগ্রামিং শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
৩. **ডিজিটাল লিটারেসি:** শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ব্যবহার, সাইবার নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
৪. **শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ:** এসটিইএম শিক্ষার কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করতে হবে, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের আরও ভালোভাবে শিক্ষা দিতে পারেন।
**এসটিইএম শিক্ষা প্রসারে বাংলাদেশের উদ্যোগ**
বাংলাদেশে এসটিইএম শিক্ষা ও দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার প্রসারে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্ল্যাটফর্ম কাজ করছে। যেমন: Future Startup, Repto, Bohubrihi, BYLC (Bangladesh Youth Leadership Center), CodersTrust Bangladesh, OpenCourseWare Bangladesh (OCW), Eshikhon, Upskill, Durbin Academy, Pathshala, Pi Labs Bangladesh, TechShop BD, BigganBaksho (Onnorokom Group Initiative), Robi-10 Minute School Coding School, STEMon BD, এবং BRAC Kumon।
Future Startup তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন ধারার শিক্ষার সুযোগ তৈরি করেছে। CodersTrust Bangladesh তরুণদের আইটি ও প্রোগ্রামিং প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, যা তাদের ফ্রিল্যান্সিং ও আন্তর্জাতিক মানের কাজে প্রস্তুত করছে। NextLab, TechShop BD, এবং Pi Labs Bangladesh এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো শিক্ষার্থীদের রোবোটিক্স, প্রোগ্রামিং এবং বৈজ্ঞানিক প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ তৈরি করছে। এইসব উদ্যোগ এসটিইএম শিক্ষার প্রসারে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। এসটিইএম শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটানো জরুরি, যাতে তারা শুধু চাকরির বাজারের জন্য প্রস্তুত না হয়ে, একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকল্পভিত্তিক ও কার্যকর শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে এবং শিক্ষকদের সঠিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। এসটিইএম শিক্ষা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সহায়ক হবে।