দ্যা নিউ ভিশন

নভেম্বর ২৫, ২০২৪ ০৭:৪৩

শিক্ষার্থীরা বলছেন, “ভয়ের সংস্কৃতি যেন আর ফিরে না আসে।”

**১০ অক্টোবর সকাল ১০টা।** চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের ঝুপড়িতে বসে গল্প করছিলেন একদল শিক্ষার্থী। তাদের আলোচনায় রাজনীতি, অর্থনীতি—সবই উঠে আসছিল। ঠাট্টার ছলে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি ও শীর্ষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করছিলেন তাঁরা। এক ফাঁকে আমি তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলাম। জানতে পারলাম, সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নানা অভিযোগ ও আশার কথা শোনানোর পর সাজ্জাদ হোসেন নামের একজন শিক্ষার্থী বললেন, “ভয়ের সংস্কৃতি যেন আর ফিরে না আসে, এটাই আমাদের চাওয়া। আমরা যে ঝুপড়িতে বসে মুক্ত মনে আড্ডা দিচ্ছি, ভিন্নমত প্রকাশ করছি—এমন পরিবর্তন ক্যাম্পাসে ধরে রাখতে হবে।”

 

সাজ্জাদ হোসেনের মতো একই সুরে কথা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী। তাঁরা চাচ্ছেন, ক্যাম্পাসে মুক্তভাবে কথা বলার সুযোগ তৈরি হোক, গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে উঠুক এবং মুক্ত চিন্তার চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠুক বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এমদাদ উল্লাহ বলছিলেন, “বিগত বছরগুলোতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে অপরাজনীতির কারখানা হিসেবে দেখেছি। এখন চাই, এটি সত্যিকার অর্থে নতুন জ্ঞান উৎপাদনের জায়গা হয়ে উঠুক, যা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি সাধন করবে।”

 

**গত ১ জুলাই থেকে বন্ধ ছিল শ্রেণি কার্যক্রম।** ওইদিন সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ বাতিলের দাবিতে শিক্ষকেরা কর্মবিরতিতে ছিলেন। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক পর্যায়ে সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এরপর ১৭ জুলাই থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয়। সরকার পতনের পর ১৯ আগস্ট শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত নিলে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে সেটি স্থগিত হয়। উপাচার্য, দুই সহ-উপাচার্যসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে এবং ১১ আগস্টে উপাচার্যসহ অন্তত ৪০ শিক্ষক প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ১৯ সেপ্টেম্বর উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। এরপর তিনি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নতুন নিয়োগ দেন এবং ৬ অক্টোবর থেকে সশরীর শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করেন। দীর্ঘ সাত বছর পর ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোয় শৃঙ্খলা ফিরে আসে, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোকানিরা স্বস্তিতে আছেন।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করতে যা কিছু দরকার, কর্তৃপক্ষ তা করার চেষ্টা করছে। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষার মাধ্যমে সেশনজট দূর করা এবং নিরাপদ ও উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করেছি।”

 

**শৃঙ্খলা আনতে কমিটি গঠন।** ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা উন্নয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিরোধিতা করা শিক্ষার্থীদের প্রতি নির্যাতন ও হামলার ঘটনা যাতে না ঘটে। ৭ অক্টোবর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, আন্দোলনের সময় যেকোনো শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি আক্রমণ, হুমকি বা হেনস্তার শিকার হয়ে থাকেন, তবে তাঁদের শান্ত থাকার অনুরোধ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা লিখিত অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন, যা পরবর্তীতে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

**হৃদয় ও ফরহাদকে স্মরণ।** দীর্ঘ বিরতির পর ৬ অক্টোবর ক্যাম্পাসে ফিরে আসার সময় শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে আন্দোলনের সময় হারানো সহপাঠীদের কথাও তাঁরা ভোলেননি। ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থীরা হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ও মো. ফরহাদ হোসেনকে স্মরণ করে বিশেষ আয়োজন করেছে। ক্যাম্পাস খোলার দিনে ক্লাসরুমে তাঁদের ছবি ও ফুল রাখা হয়েছিল ফাঁকা বেঞ্চে। ইতিহাস বিভাগের সভাপতি শামীমা হায়দার জানান, হৃদয় ও ফরহাদের স্মরণে শিক্ষার্থীরা একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন এবং নতুন সিলেবাসে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

 

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর আগে একটি প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ৬ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টায় শহীদ মিনারের সামনে উপাচার্য, সহ-উপাচার্যসহ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা লাল ব্যাজ পরে সমবেত হন এবং নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে প্রার্থনার আয়োজন করেন।

 

**আবাসনেও ফিরে এসেছে শৃঙ্খলা।** চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মো. সজল হোসেন। তিনি পাঁচ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু করেছিলেন এবং এতদিন হলের সুযোগ পাননি। ছাত্রলীগের দখলদারি ও প্রশাসনের উদাসীনতায় তাঁকে ভাড়া বাসায় থাকতে হয়েছে। অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পর হলে আসন পেয়েছেন।

 

১০ অক্টোবর বিকেলে সজলের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ফলাফলের ভিত্তিতে আলাওল হলে আসন পেয়েছেন। তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের আর কোনো রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে না।”

 

সজলের মতো প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী বৈধভাবে হলে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। ৪ অক্টোবর রাতে ফলাফলের ভিত্তিতে সাতটি হলে আসন বরাদ্দ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ এবং ৫ অক্টোবর থেকে শিক্ষার্থীরা হলে উঠছেন।

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি হলের মধ্যে ১২টি চালু আছে। এর মধ্যে ছাত্রদের সাতটি ও ছাত্রীদের পাঁচটি। ছাত্রীদের হলগুলো কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু গত সাত বছরে ছাত্রদের হলের আসন বরাদ্দ না দিয়ে ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এতে অন্তত ২১বার নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তাঁরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান।

 

ঝুপড়ি ও আবাসিক হলের আশপাশের দোকানগুলোতেও এসেছে স্বস্তি। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কারণে ভোগান্তিতে থাকা দোকানিরা জানান, এখন তাঁদের সেই সমস্যা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের ঝুপড়ির দোকানি মো. শিপন বলেন, “আমার দোকানে প্রায় তিন লাখ টাকা বাকি আছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রায় সব দোকানে বাকি রেখেছিলেন এবং নিয়মিত চাঁদাও নিতেন। প্রশাসনকে জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন এসব ঝামেলা নেই।”

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ

ঝলমলে আইপিএল নিলামের অন্য রূপ: কালো তালিকা, রাতারাতি কোটিপতি আর ক্ষমতা প্রদর্শন

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ললিত মোদি। ভারতীয় ক্রিকেট