দেশের শিক্ষা খাতে বিগত সময়ে ঘটে যাওয়া অনিয়ম, দুর্নীতি এবং ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের সদস্যদের অনেকেই এখনও সক্রিয় রয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, এবং এসব সংস্থার অন্তর্ভুক্ত ১৩টি প্রতিষ্ঠানে ঘুষ বাণিজ্য নিশ্চিত করতে ২০টি সিন্ডিকেটের অধীনে দুই শতাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী কাজ করছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, থানা শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস, শিক্ষা ভবন এবং মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ঘুষের প্রভাব দৃশ্যমান। স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, জাতীয়করণ এবং অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পেনশনের টাকা তুলতে ঘুষ দিতে হয়। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্মাণ, মেরামত, আসবাবপত্র ও শিক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটা এবং সরবরাহের প্রতিটি ধাপে সীমাহীন চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে।
শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগে সরকারি অর্থের অপচয় এবং লুটপাট চলছে। গত ১৫ বছরে শিক্ষা প্রশাসনে ৯২ কর্মকর্তা বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন, যারা সাবেক তিন মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। সাবেক এক মন্ত্রীর স্বামী ও ভাইয়ের প্রভাবের কারণে শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকের অনুসারীরা এখনও শিক্ষা প্রশাসনে বহাল রয়েছেন। যারা আগে আওয়ামী লীগ সুবিধাভোগী ছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন সরকারের সুবিধাভোগী হয়ে উঠছেন।
একজন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেন, “যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, সুবিধাভোগী দুর্নীতিবাজরা সেই সরকারের হয়ে যান।” এখনও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, সব শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিসহ (নায়েম) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগীরা সক্রিয় রয়েছেন। কিছু প্রতিষ্ঠানে দপ্তর প্রধান পদত্যাগ করলেও যারা চলতি দায়িত্বে আছেন, তারা একই আদর্শের এবং সাবেক মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠ।
গত ১৫ বছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়নে, যার ফলে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে অনিয়ম এবং দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে ঘুষ ছাড়া কিছুই হয় না। রাজধানীসহ বড় শহরগুলিতে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বা কিন্ডার গার্টেনের অনুমতি নিতে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। হাই স্কুল এবং কলেজের ক্ষেত্রে এই ঘুষের পরিমাণ সর্বনিম্ন ২ লাখ টাকা। কোনো কারণে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে, তা পুনরায় চালু করতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।
পেনশনের কাগজপত্র প্রক্রিয়াকরণের জন্য ঘুষ দিতে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের উদ্যোগ নিতে চাইলে কমপক্ষে ২০ ধাপে ঘুষ দিতে হয়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ‘ইতিবাচক পরিদর্শন রিপোর্ট’ করাতে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেওয়া যেন ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। এমপিওভুক্তির কাজের জন্য একজন শিক্ষক বা কর্মচারীকে ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এমপিওভুক্তির কাজ মাঠ প্রশাসনের হাতে দেওয়ার পর এই ঘুষ বাণিজ্য আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, ফলে শিক্ষকদের হয়রানির মাত্রাও বেড়েছে। এছাড়া নাম, বয়সসহ বিভিন্ন তথ্য সংশোধন, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পেতে উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে ফাইল পাঠাতে ৮-১০ হাজার টাকা এবং জেলা শিক্ষা অফিসে ৫-৭ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।