বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জন্য টাকার অঙ্কে বরাদ্দ গত ১৫ বছরে বেড়েছে ১০ গুণ। প্রতিষ্ঠানটির জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেট ১০০ কোটি টাকার বেশি। কয়েক বছর ধরেই বছরব্যাপী বিপুল ব্যয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন কর্মশালা ও অনুষ্ঠান। দেশজুড়ে হয়েছে নাটক ও যাত্রাপালার আয়োজন। এসবের আড়ালে বারবার চাপা পড়েছে সোয়া দুই শ কোটি টাকার হিসাবের গরমিল, নিয়োগে অনিয়ম আর সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর বহুমুখী স্বেচ্ছাচারিতার খবর। বরাদ্দের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিতে বেড়েছে দুর্নীতির পরিমাণও। এখন সেসব সংকটে জর্জরিত বাংলাদেশে সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট অন্তত ১৪ জন কর্মকর্তার কক্ষে তালা দেন প্রতিষ্ঠানেরই কিছু কর্মকর্তা। কয়েকজনকে কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
শিল্পকলা একাডেমির এসব সমস্যা দীর্ঘদিনের। নতুন মহাপরিচালক দায়িত্ব নেওয়ার পর সবার সঙ্গে কথা বলছেন। সব ধরনের মতামত শুনছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাগুলো চিহ্নিত ও সমাধান করা হবে।
খলিল আহমদ, সংস্কৃতিসচিব
অবৈধ নিয়োগ ও স্থানান্তরে দুর্নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা
২৭ আগস্ট শিল্পকলায় গেলে সেখানকার কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের কক্ষেই তালা দেওয়া হয়েছে, যাঁরা ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে নানাভাবে অবৈধ সুযোগ–সুবিধা নিয়ে অন্যদের পদবঞ্চিত করেছেন। এই সব কর্মকর্তা জানান, গত ১৩ বছরে পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি না হওয়াসহ অনেকভাবেই তাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন। এমনকি সাবেক মহাপরিচালক তাঁদের সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলতেন না।
শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষণ বিভাগের ইনস্ট্রাক্টর জিয়া উদ্দিন আহমেদ জানান, ১৭ বছর পর ২০২৩ সালে তাঁর পদোন্নতি হয়েছে। এমন আরও অনেকেই আছেন, যাঁরা সাবেক মহাপরিচালকের প্রিয়জন হতে না পারার কারণে হেনস্তার শিকার হয়েছেন।
এসবের আড়ালে বারবার চাপা পড়েছে সোয়া দুই শ কোটি টাকার হিসাবের গরমিল, নিয়োগে অনিয়ম আর সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর বহুমুখী স্বেচ্ছাচারিতার খবর।
অফিসকক্ষ আটকা থাকায় নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না সহকারী পরিচালক আবু সালেহ মো. আবদুল্লাহর মতো কয়েকজন। আবু সালেহ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ১১ আগস্ট কর্মস্থলে গিয়ে দেখেন যে তাঁর কক্ষে তালা ঝুলছে। ২২ সেপ্টেম্বর আবার কথা হলে তিনি প্রথম আলোকে জানান, আপাতত তিনি অফিসে যাচ্ছেন, তবে নিজের কক্ষে বসে কাজ করার সুযোগ পাননি। এই কর্মকর্তার নিয়োগ হয়েছিল ২০১৩ সালে জেলা কালচারাল অফিসার হিসেবে চাঁদপুরে। আবু সালেহ প্রথম আলোকে বলেন, জেলা কালচারাল অফিসারদের ঢাকা কেন্দ্রে থাকা না–থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় পরিচালনা পর্ষদ থেকে। প্রতিষ্ঠানের প্রো-বিধিমালায় এ বিষয়ে কিছুর উল্লেখ নেই।
একই কস্টিউমের খরচ পাঁচবার দেখানো থেকে শুরু করে দেশব্যাপী অনুষ্ঠানের নামে অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন বা বিদেশ সফর ও কোটি টাকার শিল্পকর্ম কেনার ভুয়া ভাউচার জমা দেওয়ার নজিরও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
সাবেক মহাপরিচালক নিয়ম লঙ্ঘন করে জেলা কালচারাল অফিসারদের ১১ জনকে ঢাকায় এনে সুবিধা দিচ্ছিলেন বলে অভিযোগ করেন কেউ কেউ। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের আটটি জেলায় কোনো কালচারাল অফিসার নেই। এসব জেলার কার্যক্রম পরিচালনা করেন পাশের জেলার কর্মকর্তারা।
নিয়োগে কারসাজি থেকে শুরু করে সরকারি টাকায় জন্মদিন উদ্যাপন করাসহ দুর্নীতির বহু উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও নিজ পদে বহাল ছিলেন সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী। ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় ‘নম্বরপত্র ঘষামাজা করে নিয়োগ পেলেন ২৫ জন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে উঠে আসে মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় অবৈধভাবে আটজনের নিয়োগের অভিযোগ। এ বিষয়ে তদন্তে প্রমাণ মিললেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নিয়োগ পাওয়া ওই আটজনের মধ্যে সাতজনই ছিলেন মহাপরিচালকের লোক নাট্যদলের সদস্য। সরকারি টাকায় নিজের জন্মদিন উদ্যাপনের অভিযোগও আছে লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে। কখনো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সামনে রেখে ৩৮ দিন আগে নিজের জন্মদিনে শহীদ মিনার পরিচ্ছন্ন করিয়েছেন। আবার সমালোচনার মুখে সে কাজ বন্ধ করে শিল্পকলার টাকায় নিজের জন্মদিনে খাইয়েছেন ৩০০ জনকে। তবে এই সবকিছুর চেয়ে বড় অঙ্কের আর্থিক অনিয়মও ঘটেছে তাঁর সময়ে।
হিসাব মিলছে না সোয়া দুই শ কোটি টাকার
শিল্পকলা একাডেমির ২২৭ কোটি ৭১ লাখ টাকার অনিয়মের তদন্ত চলছে দুই বছর ধরে। হিসাবের এই গরমিল ধরা পড়ে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের জরিপে। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের মধ্যে এই গরমিল ঘটে। এ বিষয়ে ২০২২ সালে শিল্পকলা একাডেমি জবাব দেওয়ার জন্য সময় চায়।
প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একটি–দুটি করে ভাউচারের কাগজ দিয়ে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন সে সময় এই হিসাবের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত নির্দিষ্ট একটি সময় দেওয়া হয় হিসাবের ভাউচার বা অন্যান্য খরচের খাত মিলিয়ে দেওয়ার জন্য। শিল্পকলা একাডেমির ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছিল, তবে তা কার্যকর হয়নি।
প্রতিষ্ঠানের এই বিপুল পরিমাণ অর্থের গরমিল ছাড়া রয়েছে সাবেক মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে সরাসরি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও। অনুষ্ঠানের নামে কখনো ২১ কোটি, কখনো ৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে, যা নিয়ে বিভিন্ন সময় তদন্তও হয়েছে। একই কস্টিউমের খরচ পাঁচবার দেখানো থেকে শুরু করে দেশব্যাপী অনুষ্ঠানের নামে অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন বা বিদেশ সফর ও কোটি টাকার শিল্পকর্ম কেনার ভুয়া ভাউচার জমা দেওয়ার নজিরও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
শিল্পকলা একাডেমির ২০১৯ সাল থেকে প্রকাশিত ৩টি বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশব্যাপী এই প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর গড়ে ১৭৫ থেকে ২০০টির মতো প্রদর্শনী ও কর্মশালা করেছে। এর বাইরেও আছে মুজিব বর্ষের অনুষ্ঠান, নানা ধরনের মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন। এই সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বেড়েছে বরাদ্দও।
বরাদ্দ বাড়লেও আয়োজন নিয়ে সমালোচনা
শিল্পকলা একাডেমির সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান দুই বছর পরপর দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর আয়োজন। আন্তর্জাতিক মানের এ প্রদর্শনীতে অংশ নেন অন্যান্য দেশের শিল্পীরাও। ২০১০ সালের আয়োজনে যেখানে বরাদ্দ ছিল ৯৫ লাখ টাকা, সেখানে ১৪ বছরের ব্যবধানে চলতি বছরের আয়োজনের জন্য বরাদ্দ সাড়ে ১৫ কোটি টাকা। ২০১০ সালে এতে অংশ নিয়েছিল অন্তত ২৫টি দেশ। ২০২২ সালের ১৯তম আসরে অংশ নেয় ১৪৯টি দেশ। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, কয়েকটি দেশের অংশগ্রহণ ছিল অনলাইনে।
দেশের জাতীয় বাজেটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ এক শতাংশের কম। এর মধ্যেও এই মন্ত্রণালয়ের অধীন থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পায় শিল্পকলা একাডেমি। ২০০৮-২০০৯ সালে শিল্পকলা একাডেমির রাজস্ব বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি ৭০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। টাকার পরিমাণে যা চলতি অর্থবছরে ১০ গুণ বেড়েছে।
তবে এই বিপুল অর্থ ব্যয়েও শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রম দেশের জনসাধারণের কাছে পৌঁছাতে না পারার ব্যর্থতা আছে। উদাহরণ হিসেবে গত বছর দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় যাত্রাপালা। বিভিন্ন জেলার ১২০টি পালায় খরচ ছিল ৮৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে জননীর স্বপ্নপূরণ পালাটি মঞ্চস্থ হয়েছে ২২ বার আর জননী জন্মভূমিশ্চ মঞ্চস্থ হয়েছে ১০ বার। এ দুটি পালাই ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন নিয়ে রচিত।
জনবান্ধবমুখী না হয়ে এই প্রতিষ্ঠানের সরকারের মুখপত্র হওয়ার অভিযোগ বেশ পুরোনো। তবে দেশজুড়ে বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে তরুণ শিল্পী ও প্রশিক্ষকেরা উপকৃত হয়েছেন, তেমন উদাহরণও আছে। শিল্পীরা বলেন, কর্মশালা ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে তাঁদের চর্চা বেড়েছে। তবে এই সব বিপুল আয়োজনের মধ্যে গুরুত্ব পায়নি প্রতিষ্ঠানের গবেষণার কাজটি।
দেড় দশকের গবেষণাকাজ
শিল্পকলা একাডেমির প্রতি অর্থবছরে অন্তত ছয়টি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে সাময়িকী ও স্যুভেনির প্রকাশ করলেও গবেষণাকাজের হিসাবটা মলিন। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ৫৭টি গবেষণাধর্মী বই প্রকাশ করা হয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের উপপরিচালক আফজাল হোসেন। তাঁর ভাষ্য, এই ৫৭টি বই পাণ্ডুলিপি আহ্বান করে প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বইয়ের সংখ্যা ৯।
তবে শিল্পকলা একাডেমির বই প্রকাশের তালিকা থেকে দেখা যায়, গত ১৪ বছরে শুধু সাবেক মহাপরিচালকের নামেই প্রকাশিত হয়েছে ৪০টি বই, যার অধিকাংশ লিয়াকত আলীর সম্পাদনায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে মানবতার জননী শেখ হাসিনা, বঙ্গমাতা, বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতামালা, বিশ্ববন্ধু বঙ্গবন্ধু অথবা শিশুদের চিত্রপটে বঙ্গবন্ধু—এমন গ্রন্থ রয়েছে ২৫টির বেশি।
শিল্পকলা একাডেমির এসব সমস্যা দীর্ঘদিনের। নতুন মহাপরিচালক দায়িত্ব নেওয়ার পর সবার সঙ্গে কথা বলছেন। সব ধরনের মতামত শুনছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাগুলো চিহ্নিত ও সমাধান করা হবে।
সংস্কৃতিসচিব খলিল আহমদ
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম ২ বছর শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন বরেণ্য সাংবাদিক ও সংস্কৃতিজন প্রয়াত কামাল লোহানী। এরপর ২০১১ থেকে ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট পর্যন্ত ১৩ বছর টানা মহাপরিচালক থেকে নজির তৈরি করেন লিয়াকত আলী লাকী। ১২ আগস্ট তাঁর পদত্যাগের পর ৯ সেপ্টেম্বর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান সৈয়দ জামিল আহমেদ।
ফোন না ধরায় অভিযোগের বিষয়ে লিয়াকত আলীর বক্তব্য জানা যায়নি।
জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কর্তৃপক্ষ কী ভাবছে, তা জানতে চাইলে সংস্কৃতিসচিব খলিল আহমদ গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, শিল্পকলা একাডেমির এসব সমস্যা দীর্ঘদিনের। নতুন মহাপরিচালক দায়িত্ব নেওয়ার পর সবার সঙ্গে কথা বলছেন। সব ধরনের মতামত শুনছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাগুলো চিহ্নিত ও সমাধান করা হবে।