কোভিড মহামারির পর সবচেয়ে কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে চলতি অর্থবছরে। বিশ্বব্যাংকের এই পূর্বাভাস নিশ্চিত করছে যে গতি হারাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত কয়েক মাসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও শ্লথ হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, অর্থনীতিতে যেসব অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, সরকারের উচিত সেগুলোর দিকে দ্রুত মনোযোগ দেওয়া।
১০ অক্টোবর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেটে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। তবে এটি প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাসের মধ্যবর্তী পয়েন্ট। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনীতি ঠিকমতো না চললে প্রবৃদ্ধি কমে হতে পারে ৩ দশমিক ২ শতাংশ, আর খুব ভালো করলে হবে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
দেশের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়ায় যদি প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী তলানিতে গিয়ে ঠেকে, তাহলে তা হবে কোভিডের সময়ে অর্জিত প্রবৃদ্ধির চেয়েও কম। করোনোভাইরাস মহামারির সবচেয়ে খারাপ সময়ে ২০১৯–২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছিল। এ কারণে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে বন্ধ ছিল শিল্পের উৎপাদন কর্মকাণ্ড। মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য।
বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক নিয়ামক হতে পারে দুটি বিষয়। একটি সংস্থাটির কথায় ‘উল্লেখযোগ্য’ অনিশ্চয়তা। বিশ্বব্যাংক বলছে, এই অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ ও শিল্পের প্রবৃদ্ধি দুর্বল হবে। অন্য বিষয়টি হলো দেশের বিভিন্ন এলাকার বন্যা, যা কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি সীমিত করে দেবে। এ কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সার্বিকভাবে কমবে, যা গত অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা এখন অনিশ্চয়তা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘অনিশ্চয়তা যদি কাটানো না যায়, তাহলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের পথে হাঁটবেন না। অনিশ্চয়তার মধ্যে বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। টাকাটা তাঁরা পকেটে রেখে দেন। তাই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে সরকারকে চেষ্টা করতে হবে, পদক্ষেপ নিতে হবে।’
জাহিদ হোসেনের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তিনটি সূত্র থেকে এই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, যার কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং মালিক, শ্রমিক ও সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় একটি সমঝোতার পরও যা চলমান রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক খাতের দুর্বলতা, যা ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তৃতীয়ত, জ্বালানি খাতের দীর্ঘদিনের সমস্যা।
সংকোচনের ধারায় অর্থনীতি
অর্থনীতির সাম্প্রতিক শ্লথ গতি অবশ্য হঠাৎ আসেনি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০২২–২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত অর্থবছরেই বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্লথ হতে শুরু করে, যে ধারা চলতি বছরে আরেকটু জোরদার হতে পারে। অর্থনীতির গতি–প্রকৃতির দিকে নজর রাখে যেসব দেশীয় প্রতিষ্ঠান, তারা জানাচ্ছে, টানা তিন মাস ধরেই সংকোচনের ধারায় রয়েছে অর্থনীতি।
দেশের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ যৌথভাবে প্রতি মাসে যে পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (পিএমআই) প্রকাশ করে, তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশে জুলাই ও আগস্ট মাসের ধারাবাহিকতায় সেপ্টেম্বর মাসেও অর্থনীতি সংকোচনের ধারায় ছিল। তবে আগস্ট মাসের তুলনায় সংকোচনের গতি সামান্য কমেছে। আগস্ট মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বর মাসে পিএমআইয়ের মান ৬ দশমিক ২ পয়েন্ট বেড়েছে।
সেপ্টেম্বর মাসে পিএমআই সূচক ছিল ৪৯ দশমিক ৭, আগস্ট মাসে যা ছিল ৪৩ দশমিক ৫। পিএমআই সূচকের মান ৫০-এর নিচে থাকার অর্থ হলো, অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে এই সূচক প্রণয়ন করা হয়, অর্থনীতির মূল চারটি খাতের ভিত্তিতে—কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ ও সেবা। দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসে কেবল উৎপাদন খাত সম্প্রসারণের ধারায় ফিরেছে। বাকি তিনটি খাত সংকোচনের ধারায় ছিল।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, সার্বিকভাবে অর্থনীতির অবস্থা ‘যথেষ্ট খারাপ’। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, দুর্নীতি, প্রবৃদ্ধির হিসাবে গরমিলের কারণে অর্থনীতিকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হচ্ছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির তিনটি প্রধান খাত রাইস (চাল অর্থাৎ কৃষি), রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) ও আরএমজি (তৈরি পোশাক)। এগুলো কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পে পুঁজির ব্যবস্থা করতে হবে। সারের যাতে ঘাটতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর কর্মীদের বিদেশ গমন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, তা–ও নিশ্চিত করতে হবে।’
অর্থনীতির বড় অনিশ্চয়তা এখন উৎপাদন খাতে। নানা রকম উদ্যোগের পরও সবচেয়ে বড় রপ্তানি শিল্প পোশাক খাতে উৎপাদনব্যবস্থা এখনো ভঙ্গুর রয়ে গেছে। জুলাই মাস থেকে সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের পোশাকশিল্প এলাকা শ্রমিক বিক্ষোভ দেখছে। সম্প্রতি পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও তা টেকসই হয়েছে কি না, সেটি এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। পোশাকশিল্পের মালিকদের সমিতি জানিয়েছে, তাদের উৎপাদন ও রপ্তানিতে যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনই কিছু ক্রয়াদেশ অন্য দেশে চলে গেছে।
এ মাসের গোড়ার দিকে বিশ্বব্যাংকের ‘বিজনেস রেডি’ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এটি মূলত ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ বা ‘সহজে ব্যবসার সূচক’ শীর্ষক প্রতিবেদনের বিকল্প হিসেবে এসেছে। কোনো কোম্পানির কাজ শুরু করা, পরিচালনা ও বন্ধ করা এবং প্রতিযোগিতার কাজের ধরন পরিবর্তনের মতো ১০টি বিষয়ের ভিত্তিতে নতুন প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশ খুব ভালো অবস্থানে নেই।
অর্থনীতির চার চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সংস্কার কার্যক্রমে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে আছে। আবার বিজনেস রেডির কোনো কোনো সূচকে বাংলাদেশ এমনকি নেপাল ও পাকিস্তান চেয়েও পিছিয়ে আছে। আছে নীতি নিয়ে অনিশ্চয়তা। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কখন কী নিয়ম চালু করবে, তার নিশ্চয়তা থাকে না। এ কারণে ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তায় ভোগেন।
বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে গত আওয়ামী লীগ সরকার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। তবে বিশ্বব্যাংক আগেই তা অর্জনযোগ্য নয় বলে জানিয়েছিল। গত এপ্রিলে চলতি অর্থবছরের জন্য সংস্থাটি ৫ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। এখন তারা প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস আরও বেশ খানিকটা কমিয়ে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনল।
নতুন প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে বিশ্বব্যাংক দেশের অর্থনীতির জন্য চারটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো মূল্যস্ফীতি, যা কিছুটা কমলেও উচ্চহারে থাকবে; বহিস্থ খাতের চাপ, যার মূল কারণ প্রয়োজনের তুলনায় কম রিজার্ভ; আর্থিক খাতের দুর্বলতা, যা দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কাজ করছে এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের রাজনৈতিক গতিপথ কী হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কেবল বাড়ছেই।
জাহিদ হোসেন মনে করেন, যদি অনিশ্চয়তার বিষয়গুলো দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যায় এবং প্রকৃতি শেষ পর্যন্ত পক্ষে থাকে, তাহলে চলতি অর্থবছরে হয়তো ৫ শতাংশের একটু বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। তিনি একে ‘শোভন প্রবৃদ্ধি’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁর কথায়, ‘আমাদের চেষ্টা করতে হবে ৫ দশমিক ২ শতাংশের দিকে যেতে।’
চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি সরকারি প্রাক্কলন অনুযায়ী হবে না বলে ধারনা করছেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তবে তাঁর মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির যে অন্তর্নিহিত শক্তি রয়েছে, তাকে ব্যবহার করে যদি একটি কাম্য পরিবেশ তৈরি করা যায়, তাহলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের সমস্যাগুলো থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিতে পারি, তাহলে আগামী বছর অর্থনীতিতে আবার চাঙা ভাব ফিরে আসবে—এটা আমরা আশা করতে পারি।’