পেশাজীবী সংগঠন অর্থনীতি সমিতির নেতৃত্ব নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। একটি পক্ষ নিজেদের অন্তর্বর্তী বা অ্যাডহক কমিটি দাবি করে গত ১২ ফেব্রুয়ারি সংগঠনের কার্যালয় দখলে নিয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। ফলে সমিতির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্যরা কার্যালয়ে যেতে পারছেন না। এভাবে ২৩ দিন ধরে সমিতির কার্যালয় ও কার্যক্রম দুটিই বন্ধ রয়েছে।
পাঁচ দশকের যাত্রায় অর্থনীতি সমিতি কখনোই নেতৃত্ব নিয়ে এমন টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েনি। সমিতির একাধিক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, নেতৃত্ব নিয়ে পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন এবং কার্যালয়ে হামলা ও দখলের ঘটনায় অর্থনীতি সমিতির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, গত দেড় দশকে সমিতি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ একটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি ছিল। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে তারা নেতা নির্বাচন করেছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব ছিল। সে জন্য রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে।
এদিকে অর্থনীতি সমিতির অন্তর্বর্তী কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা (নতুন অ্যাডহক কমিটি) যা করেছে, তা কোনো সভ্য মানুষ করতে পারে না। আমরা প্রশাসনকে অবহিত করেছি। আশা করছি অচিরেই অচলাবস্থার নিরসন হবে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা এক বছরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চাই।’
১৯৭৪ সালে গঠিত অর্থনীতি সমিতির সদস্যসংখ্যা বর্তমানে প্রায় চার হাজার। সারা দেশের অর্থনীতির ছাত্র, শিক্ষক, ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা এই সমিতির সদস্য। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদেরা এ সমিতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭২-৭৪ মেয়াদে অর্থনীতি সমিতির সহসভাপতি ছিলেন।
এক সমিতি, দুই কমিটি
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়। অর্থনীতি সমিতির গত নির্বাচনে পরাজিত প্যানেলের বেশ কয়েকজন সদস্য সংগঠনের তৎকালীন কমিটির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এর নেতৃত্ব দেন নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান।
সমিতির তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেও তাঁদের শান্ত করতে ব্যর্থ হন। পরে ৩০ সেপ্টেম্বর আন্দোলনকারীরা সমিতির কার্যালয়ে বৈঠক করার ঘোষণা দিলে কমিটির সদস্যরা ফটকে তালা লাগান। ওই দিনই তালা ভেঙে কার্যালয়ের নিচতলায় বৈঠক করে অ্যাডহক কমিটি করেন আন্দোলনকারীরা। সেই কমিটিতে সভাপতি হন আজিজুর রহমান। এর তিন সপ্তাহ পর নির্বাচিত কমিটির সদস্যরা কার্যালয়ে ঢুকলেও পরে তা আবার দখল করে নেয় অ্যাডহক কমিটি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আবার সমিতির দখল নেয় আগের কমিটি। তখন তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহকে আহ্বায়ক করে ২৯ সদস্যের অন্তর্বর্তী কমিটি করে। ৭ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী কমিটি দায়িত্ব নেয়।
অন্যদিকে আজিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন অ্যাডহক কমিটির নেতারা গত ১২ ফেব্রুয়ারি আবারও অর্থনীতি সমিতির কার্যালয়ের দখল নেন। পরে ১৭ ফেব্রুয়ারি সকালে পুলিশ নিয়ে অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী কমিটি পুনরায় দখল নেয়। সন্ধ্যার পর পুলিশ চলে গেলে আবার বেদখল হয় সমিতির কার্যালয়। তার পর থেকেই কার্যালয়টি তালাবদ্ধ রয়েছে। তবে ভবনের ওপরের তলাগুলোতে স্কুল অব ইকোনমিকসের কার্যক্রম চলছে।
অন্তর্বর্তী কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব উল্লাহ, সদস্যসচিব মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনসহ অন্যরা ২৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ১২ ফেব্রুয়ারি আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে বহিরাগতদের নিয়ে সমিতির কার্যালয়ে সশস্ত্র আক্রমণ হয়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙচুর, ব্যাংকের চেক বইসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র গায়েবের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় সাধারণ ডায়েরিও করা হয়।
কেন বারবার সমিতির কার্যালয় দখল করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে অন্য অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাহবুব ই জামিল গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘১৬-১৭ বছর একটি গোষ্ঠীর কবজায় ছিল অর্থনীতি সমিতি। নিয়মনীতি ছাড়া সদস্য করা হয়েছে। নির্বাচন বলে কিছু ছিল না। সে কারণে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আমরা আন্দোলন করে তাদের তাড়িয়েছি। তবে আমাদের বাদ দিয়ে অন্তর্বর্তী কমিটি করা হয়েছে। আসলে এটি সাবেক কমিটির ধারাবাহিকতা।’
সমস্যার সমাধান কোথায়, জানতে চাইলে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি আজিজুর রহমান বলেন, ‘অচলাবস্থা নিরসনে প্রয়োজনে আমরা আলোচনায় বসতে রাজি আছি।’
প্রসঙ্গত, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১০ সালে অর্থনীতি সমিতির সভাপতি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল বারকাত। তিনি টানা দুই মেয়াদে সভাপতি হন। ২০১৮ সাল থেকে আবার দুই মেয়াদে সভাপতি ছিলেন আবুল বারকাত। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাঁকে ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয়। পাঁচ বছর এই পদে ছিলেন তিনি। আবুল বারকাতের কমিটিতে দুবার সাধারণ সম্পাদক হন জামালউদ্দিন আহমেদ। পরে তিনিও জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
অর্থনীতি সমিতির অচলাবস্থা নিয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সেমিনার, দ্বিবার্ষিক সম্মেলনসহ বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে অর্থনীতিচর্চাকে উৎসাহিত করেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছিলাম, সমিতি পেশাদারির সঙ্গে তার কাজ করতে পারছিল না। বর্তমানে নেতৃত্ব নিয়ে যা হচ্ছে, তা খুবই অনভিপ্রেত। যত দ্রুত সম্ভব আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসা প্রয়োজন। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতিবিদদের গোষ্ঠীগত অসম্মানই হবে।’