টানা তিন মাস ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি হওয়ায় সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।
কোটা আন্দোলন ও পরবর্তী ঘটনাগুলোর প্রভাবে গত জুলাইয়ে দেশের পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে ধস নামে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন চ্যালেঞ্জে সত্ত্বেও পণ্য রপ্তানি বাড়তে থাকে। টানা তিন মাস ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তাতে চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস জুলাই-ডিসেম্বরে ২ হাজার ৪৬২ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি এর আগের ২০২৩–২৪ অর্থবছরের একই সময়ের ২ হাজার ১৮৮ কোটি ডলারের রপ্তানির চেয়ে ২৭৪ কোটি ডলার বা ১২ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি।
আমাদের তৈরি পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) মূল্যস্ফীতির চাপ কমে এসেছে। আবার ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মজুত পণ্যও কমে আসছে। সে জন্য ক্রয়াদেশ বাড়ছে। যদিও পোশাকের পরিমাণ বাড়লেও দাম কম। না হলে রপ্তানি আয় আরও বেশি হতো।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে পণ্য রপ্তানির এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। এই হিসাবের মধ্যে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) প্রচ্ছন্ন রপ্তানি এবং স্যাম্পল বা নমুনা রপ্তানির তথ্যও সংযুক্ত আছে। যদিও পরিমাণটি খুব বেশি নয়।
একাধিক রপ্তানিকারক বলেন, যুদ্ধ আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধাক্কা কাটিয়ে আবার তৈরি পোশাকের ব্যবসা ফিরছে। পাশাপাশি চীন থেকেও ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে আগামী বসন্ত ও গ্রীষ্ম মৌসুমের জন্য ভালো ক্রয়াদেশ পেয়েছে কারখানাগুলো। সব মিলিয়ে রপ্তানি বেড়েছে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের তিনটি বড় উৎস হলো রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এবং বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণ। এর মধ্যে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কমে। সদ্য সমাপ্ত ডিসেম্বরে ২৬৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। এ আয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় প্রায় ৩২ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ দুই বছরের বেশি সময় ধরে ডলার-সংকটে ভুগছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভের। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এসে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ায় রিজার্ভের পতন থামে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গত ২৪ ডিসেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ২ হাজার ৪৯৭ কোটি ডলারের বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) স্বীকৃত বিপিএম ৬ হিসাব মান অনুযায়ী, দেশের রিজার্ভ এখন ২ হাজার ১৮ কোটি ডলার, যা এক মাস আগে ছিল ১ হাজার ৮৬১ কোটি ডলার।
এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, গত অক্টোবর ও নভেম্বরে যথাক্রমে ৪১৩ ও ৪১১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত মাসে, অর্থাৎ ডিসেম্বরে রপ্তানি বেড়ে ৪৬৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় ১৮ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ৩৯২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল।
চলতি অর্থবছরের শুরুতে পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান নিয়ে বড় কেলেঙ্কারি তথ্য ফাঁস হয়। এর আগে বেশ কয়েক মাস ধরে রপ্তানিকারকেরা অভিযোগ করছিলেন যে রপ্তানির পরিসংখ্যান ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইয়ে হঠাৎ প্রকৃত পণ্য রপ্তানির ভিত্তিতে লেনদেন ভারসাম্যের তথ্য প্রকাশ করে। সে সময় পণ্য রপ্তানির হিসাবে বড় ধরনের গরমিলের তথ্য উঠে আসে। তখন দেখা যায়, পণ্য রপ্তানি একলাফে ৫৫ বিলিয়ন থেকে কমে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ হাজার ৪৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। সেই রপ্তানি তার আগের ২০২২–২৩ অর্থবছরের তুলনায় ৪ দশমিক ২২ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ৬৪৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।
চলতি অর্থবছরের শুরুতে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। তখন কয়েক দিন কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়। আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পণ্য রপ্তানির বড় খাত তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রম অসন্তোষ শুরু হয়। এ সময় সাভারের আশুলিয়ায় ও গাজীপুরের বেশ কিছু কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়। পরে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নেয়। তারপরও বিভিন্ন ইস্যুতে পোশাক খাতে প্রায়ই অসন্তোষের ঘটনা ঘটছে। এতে রপ্তানি কমবেশি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের তৈরি পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) মূল্যস্ফীতির চাপ কমে এসেছে। আবার ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মজুত পণ্যও কমে আসছে। সে জন্য ক্রয়াদেশ বাড়ছে। যদিও পোশাকের পরিমাণ বাড়লেও দাম কম। না হলে রপ্তানি আয় আরও বেশি হতো।’