ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে খেলাপি ঋণ প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে প্রথমবারের মতো দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর পূর্ববর্তী গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পদত্যাগ করেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি খেলাপি ঋণের তথ্য গোপনের বিষয় নিয়ে পূর্বে সমালোচনা করেছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কারণে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশের চাপ ছিল, যা মার্চ থেকে খেলাপি ঋণ বাড়ানোর পেছনে একটি কারণ। বিশেষ সুবিধা নিয়ে ফুলেফেঁপে ওঠা অনেক ব্যবসায়ী ইতিমধ্যে পালিয়ে গেছে, ফলে ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে বলে ব্যাংকাররা সতর্ক করেছেন।
তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ ছিল ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা, যা মার্চের শেষে ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ শতাংশ।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় আসার সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মার্চে এটি প্রথমবারের মতো অর্ধলাখ কোটি টাকা ছাড়ায় এবং ২০১৯ সালের মার্চে এক লাখ কোটি টাকার সীমা ছাড়ায়। এরপর বিভিন্ন সুবিধার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা হয়েছে, তবে ২০২১ সালে কেউ ১৫ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৫০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করলেই খেলাপি ঋণ থেকে মুক্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকের ১০ শতাংশের নিচে নামানোর জন্য চাপ রয়েছে। এর মানে, খেলাপি ঋণ কম দেখানোর জন্য আগের মতো নীতি-সহায়তা প্রদান সম্ভব নয়। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ তিন মাস পর বিবেচিত হবে এবং পরবর্তী বছর থেকে কিস্তি দেওয়ার তারিখের পরদিন থেকে ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে ধরা হবে। এছাড়া, বেনামি ও ভুয়া ঋণ ঠেকানো, ঋণ সমন্বয় ও সীমা বৃদ্ধি বন্ধ করা হবে এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে জানা যায়, জুন শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ।