দ্যা নিউ ভিশন

‘জরুরি বিপৎকালীন তহবিল’ গঠনের সুপারিশ করবে শ্রম সংস্কার কমিশন

শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধের জন্য ‘জরুরি বিপৎকালীন তহবিল’ গঠনের সুপারিশ করবে নবগঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। কোনো কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে এ তহবিল থেকে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের সুযোগ তৈরি হবে। কারখানার মালিকেরাও জরুরি প্রয়োজনে তহবিলটি থেকে ঋণ নিতে পারবেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার বিজয়নগরের শ্রম ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ এ কথাগুলো বলেন। জবাবদিহিমূলক, মানবিক ও মর্যাদাপূর্ণ শ্রমব্যবস্থা তৈরির জন্য দুই সপ্তাহ আগে গঠিত এ কমিশনের প্রথম সংবাদ সম্মেলন এটি। কমিশনকে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সদস্য শ্রম ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মাহফুজুল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের অধ্যাপক জাকির হোসেন, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সভাপতি তপন দত্ত, বাংলাদেশ লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এ কে এম নাসিম, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সাবেক সভাপতি কামরান টি রহমান, শ্রমিক সংগঠক তাসলিমা আখতার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

লিখিত বক্তব্যে কমিশন প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা জুলাই আন্দোলনে রিকশাচালক, দোকান কর্মচারী, কারখানা শ্রমিকসহ শ্রমজীবী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখেছি। দেখেছি জীবন বাজি রেখে এগিয়ে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের। তাঁরা পরিবর্তনকামী কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি।’

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এমন এক পরিস্থিতিতে শ্রম সংস্কার কমিশন কাজ শুরু করেছে যখন গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে সরকার-মালিক-শ্রমিক সবার প্রত্যাশা অনেক। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বকেয়া মজুরির দাবিতে শ্রম অসন্তোষ চলমান। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত, খোলা আকাশের নিচে বজ্রপাতে আহত-নিহত হচ্ছেন শ্রমিক। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) ছাড়াই কাজ করছেন শ্রমিক। ভোরবেলায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসে ‘শ্রমিকের হাট’, মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞাকালীন কর্মহীন সময়ে প্রান্তিক শ্রমজীবী জেলেদের জন্য বরাদ্দ সামান্য কয়েক কেজি চাল। পেটের দায়ে নদীতে নামলে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে রোজগারের অবলম্বন জাল। সামান্য কারণে রিকশাচালকের জীবিকার অবলম্বন রিকশা গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

কমিশন প্রধান বলেন, বিগত বছরগুলোতে শ্রম বিষয়ে বিশ্বমহলে দেশের ভাবমূর্তি যতটা ক্ষুণ্ন হয়েছে, তা পুনরুদ্ধারের সুপারিশ করা হবে। সুপারিশের মধ্যে থাকবে শ্রমিকের জন্য গণতান্ত্রিক শ্রম আইন; শোভন ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থান; কাজের নিরাপত্তা; জাতীয় ন্যূনতম ও ন্যায্য মর্যাদাপূর্ণ মজুরি; নিরাপদ কর্মপরিবেশ; সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা; সংগঠিত হওয়া, দর-কষাকষি ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার। এ ছাড়া অবাধে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন ও ব্যবসায়ী সংগঠনের চর্চা, শিল্প খাত বিকাশের স্বার্থে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি পর্যালোচনা এবং ন্যায্য অংশীদারত্ব নিশ্চিতের বিষয়ে সুপারিশ করা হবে।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বলতে দ্বিধা নেই যে দেশের শ্রমজীবী মানুষ যুগ যুগ ধরে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে শ্রমশক্তি রয়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ। তবে “শ্রমিক” হিসেবে শিল্প খাতের শ্রমিকদের আইনগত স্বীকৃতি থাকলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সিংহভাগ শ্রমিকেরই সে স্বীকৃতি নেই। আবার দেশে ও বিদেশে কর্মরত আমাদের শ্রমিক ভাইবোনেরা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলেও রাষ্ট্রের মুনাফামুখী নীতির কারণে আজ পর্যন্ত তাঁরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রত্যাশিত মর্যাদা পাননি। সামাজিকভাবেও তাঁরা মর্যাদাহীন।’

‘শ্রমিককে ছোট করে দেখা আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে গেছে’ বলে মন্তব্য করে কমিশনপ্রধান বলেন, ঘরে ঘরে গৃহশ্রমিক নির্যাতন, প্রতিনিয়ত নির্মাণশ্রমিকদের মৃত্যু, জাহাজভাঙা বা পরিবহন খাতের দুর্ঘটনা শ্রমিকদের প্রতি নীতিনির্ধারক ও সমাজের অবহেলাজনিত দৃষ্টিভঙ্গিই ফুটিয়ে তোলে। শুধু তা-ই নয়, সমাজের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অংশ পরিচ্ছন্নতাকর্মীদেরও সমাজকাঠামোর বাইরে রাখা হয়েছে। তাঁদের বাইরে রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ে তোলা যাবে না।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, রাষ্ট্র এখনো কর্মক্ষম সব মানুষের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে পারেনি। শ্রমিকেরা নিজেদের কাজ নিজেরাই খুঁজে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কোনো ধরনের আইনগত সুরক্ষা ছাড়াই তথ্যপ্রযুক্তি, পরিবহন, খাবার সরবরাহ ইত্যাদি খাতে প্রচুর মানুষ কাজ করছেন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত দেশের ৮৫ শতাংশের বেশি শ্রমিক আইনি সুরক্ষার বাইরে। প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি শ্রমশক্তি কর্মবাজারে যুক্ত হচ্ছে। ফলে চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা চরম আকার ধারণ করেছে। এই পরিস্থিতিকে পুঁজি করে ব্যাপক শ্রমশোষণ চলছে, চলছে শ্রমের অপব্যবহার। আবার অন্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরিতে বিদেশে গিয়ে তাঁরা বিপজ্জনক ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিদেশ থেকে প্রতিদিন দেশে ফেরত আসছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের লাশ।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এত দিন বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বাংলাদেশের সস্তা শ্রমের ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। উন্নয়নের জরুরি শর্ত হিসেবে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ সীমিত করার চেষ্টা হয়েছে। অথচ সুষ্ঠু শিল্পসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমের কোনো বিকল্প নেই। শ্রমিক ও মালিক একে অপরকে প্রতিপক্ষ বিবেচনা করার সংস্কৃতি, যা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে পুরো জাতিকেই এর মাশুল গুনতে হবে।

৪৬টি শিল্প খাতে সরকার নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করলেও কোনো ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ ঘোষণা করা হয়নি উল্লেখ করে বলা হয়, যাঁরা শ্রম আইনের বাইরে রয়েছেন, তাঁদের মজুরির কোনো মানদণ্ড ঠিক করা হয়নি। এতে মজুরিবৈষম্য তীব্র হয়ে উঠেছে। আর বেড়েই চলছে আয়বৈষম্য।

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ

চশমার যত্ন

চশমা এখন শুধু প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যম নয়, বরং ফ্যাশনের ট্রেন্ডেও