২০১৮ সালের গ্রীষ্মে যখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বেইজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেন, তখন চীনের অর্থনীতি ছিল শক্তিশালী। এমনকি ধারণা করা হচ্ছিল, শিগগিরই চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।
কিন্তু ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার কয়েক মাস আগে চীনের সেই অর্থনৈতিক শক্তি অনেকটাই ক্ষুণ্ন হয়েছে; সম্পত্তি খাতের সংকট, ঋণের চাপ ও মূল্যহ্রাসের মতো সমস্যার মোকাবিলায় লড়াই করছে চীন। এ কারণে আরেকটি বাণিজ্যযুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে না।
কিন্তু বাইরের পরিস্থিতি দেখে অনেক সময় মূল বিষয়টি বোঝা যায় না। বাস্তবতা হলো, নির্বাচিত-প্রেসিডেন্টের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে চীনের নেতৃত্ব এখন আরও ভালোভাবে প্রস্তুত। ট্রাম্প তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রীত পণ্যের ওপর ৬০% শুল্ক আরোপের পথে হাঁটলে চীন বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করবে। যেমন বাণিজ্যের বহুমুখীকরণ, মার্কিন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে লক্ষ্যভিত্তিক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা ও অভ্যন্তরীণ ভোগ চাঙা করা।
চীন অনেক দিন ধরেই এই প্রস্তুতি নিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর তাদের বাণিজ্য নেটওয়ার্কে আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে মন্তব্য করেছেন ট্রেড ওয়ার আটলান্টিক কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ ফেলো ডেক্সটার রবার্টস।
প্রথম বাণিজ্যযুদ্ধ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জমানায়ও অব্যাহত ছিল। অর্থাৎ, প্রায় ছয় বছর ধরে বেইজিং এবং চীনা কোম্পানিগুলো এই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাদের বাণিজ্য–নির্ভরতা অনেকাংশে কমেছে। চীনের বাণিজ্যিক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং বেশ দ্রুতই তা ঘটছে।
২০২২ সালেও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল রেকর্ড পরিমাণ। তবে গত বছরে চীনকে পেছনে ফেলে মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির সবচেয়ে বড় উৎসে পরিণত হয়েছে। চীন ২০ বছর ধরে এই অবস্থান ধরে রেখেছে, কিন্তু গত বছরে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রপ্তানি ২০ শতাংশ কমে ৪২৭ বিলিয়ন বা ৪২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার দাঁড়িয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাথিউস এশিয়ার তথ্যানুসারে, গত বছর চীনের মোট রপ্তানির ৩০ শতাংশের মতো হয়েছে জি-৭–ভুক্ত ধনী দেশগুলোতে, ২০০০ সালে যা ছিল ৪৮ শতাংশ। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি কমলেও বৈশ্বিক রপ্তানি বাণিজ্যে চীনের হিস্যা বর্তমানে ১৪ শতাংশ, প্রথম দফায় ট্রাম্প শুল্ক আরোপের আগে যা ছিল ১৩ শতাংশ।
গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে চীনের সহকারী বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং শাওয়েন সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাইরের ধাক্কা মোকাবিলা ও প্রতিরোধের সক্ষমতা আমাদের আছে।’
পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন সম্ভবত বড় কিছু করবে না, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড বিক্রি (যেখানে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা) অথবা মুদ্রা ইউয়ানের বড় ধরনের অবমূল্যায়ন। গত তিন বছরে এমনিতেই ইউয়ানের ১২ শতাংশ মূল্যহ্রাস হয়েছে।
এসব নাটকীয় পদক্ষেপে কাজ হবে না বলে মনে করেন ম্যাথিউস এশিয়ার চীনবিষয়ক কৌশলবিদ অ্যান্ডি রথম্যান। তিনি আরও বলেন, চীন সাধারণত সরাসরি এভাবে প্রতিশোধ নেয় না।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুল্কের ক্ষেত্রে ইটের বদলে পাটকেল মারার নীতি আশা করা ঠিক হবে না। ইতিমধ্যে চীনে কর্মরত বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। শুল্কের জবাবে তারা মার্কিন কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ বাড়াতে পারে, এমন হতে পারে যে তারা কিছু কোম্পানিকে লক্ষ্য করতে পারে, যাদের তারা চীনছাড়া করবে।
সেপ্টেম্বরে বেইজিং জানিয়েছিল, ফ্যাশন খুচরা বিক্রেতা পিভিএইচ করপোরেশনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। অভিযোগ, তারা শিনজিয়াং অঞ্চল থেকে সুতা নিতে চায়নি। ওই অঞ্চলে চীন সরকার বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ। এর জেরে শেষমেশ চীনে ব্যবসা করা বড় এই মার্কিন কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।
গত বছর চীনা পুলিশ সাংহাইয়ে মার্কিন ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বেইন অ্যান্ড কোম্পানির কার্যালয়ে অভিযান চালায়। এই ঘটনায় মার্কিন ব্যবসায়ী মহলে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। সেই ঘটনার পর রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়, নিরাপত্তা বাহিনী আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যাপভিশনের শাংহাই ও নিউইয়র্ক কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, চীনের পক্ষে মার্কিন ট্রেজারি নোট বিক্রি করার চেয়ে মার্কিন প্রতিষ্ঠান বা কৃষি শিল্পগুলোর ওপর প্রতিশোধ নেওয়া অধিক বাস্তবসম্মত। কারণ, এ ধরনের বিলের ক্রেতার অভাব নেই; এগুলো বিক্রি করলে বেইজিংয়ের স্বার্থহানি হতে পারে। ট্রাম্প নতুন শুল্ক আরোপ করলে চীন ইউয়ানের দরপতন ঘটিয়ে রপ্তানি বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারে এমন সম্ভাবনা প্রসঙ্গে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এটা তাঁদের পরিকল্পনায় নেই।
বিশ্লেষকেরা বলেন, ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে হঠাৎ ইউয়ানের অবমূল্যায়ন করা হলে শেয়ারবাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি চীন সরকার জানিয়ে দিয়েছে, তারা শেয়ারবাজারে আস্থা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে, যেন এই বাজার দেশীয় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে।
এ ছাড়া চীন সরকার ইউয়ানকে মার্কিন ডলারের নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। বিশেষ করে ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার সম্পদ স্থগিত করার কারণে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই সব দেশের কাছে ইউয়ানকে গ্রহণযোগ্য করতে চায় তারা।
ঘর পরিষ্কার করা
ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধির অঙ্গীকার কেবল চীনের জন্য প্রযোজ্য নয়। তিনি সব আমদানি করা পণ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন; বর্তমানে গড় শুল্কহার ২ শতাংশ, ক্ষেত্রবিশেষে শুল্ক নেই। এ ছাড়া তিনি মেক্সিকোতে তৈরি গাড়ি এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকোতে স্থানান্তর করা কারখানার উৎপাদিত পণ্যে ১০০ থেকে ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদদের হিসাব, ৬০ শতাংশ আমদানি শুল্কের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার অর্ধেক হয়ে যেতে পারে। পিটারসন ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষণ অনুসারে, এই শুল্ক আরোপিত হলে যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারপ্রতি বার্ষিক ব্যয় ২ হাজার ৬০০ ডলার বেড়ে যেতে পারে। তবে চীন ১৪০ কোটি মানুষের দেশ। তাদের বড় একটি অভ্যন্তরীণ ভোক্তা বাজার আছে। যথাযথ নীতি প্রণয়ন করা হলে, তারা এই বাজার কাজে লাগাতে পারে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্কের বিরুদ্ধে বেইজিং সবচেয়ে ভালো যে জবাব চীন দিতে পারে তা হলো, নিজেদের ঘর ঠিক করা; চীনের উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। এসব উদ্যোক্তা শহরাঞ্চলের ৯০ শতাংশ চাকরির জোগান দেন। অধিকাংশ উদ্ভাবন তাঁরাই করে থাকেন। এতে ভোক্তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি আরও কমলে অভ্যন্তরীণ বাজারের বিক্রি দিয়ে তা পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
গত মাসে চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির গতি আরও কমেছে। ভোক্তা ব্যয় কমে যাওয়া এর মূল কারণ, সম্পদ বাজারের চলমান সমস্যার প্রভাবও আছে। সেই প্রান্তিকে মোট দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ৪ দশমিক ৬। চীন সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হলো ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা।
ম্যাকোয়ারি ব্যাংকের চীনবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ ল্যারি হু সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদন লিখেছেন, বড় ধরনের পদক্ষেপগুলো হয়তো ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণা হওয়ার পরই আসবে। জানুয়ারি মাসে তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর বিষয়টি ঘটতে পারে।
ল্যারি আরও বলেন, রপ্তানি অনেকাংশে মার খেলে নীতিনির্ধারকদের আর কোনো বিকল্প থাকবে না, তখন তাদের প্রণোদনা বৃদ্ধি করে পরবর্তী স্তরে যেতে হবে। তখন চীন সরকারের গৃহায়ণ নীতি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তবে ইতিহাস থেকে দেখা যায়, বেইজিং সাধারণত পরিস্থিতি দেখে প্রতিক্রিয়া জানায়…পূর্বাভাসে নয়।