সরকারি অবকাঠামো প্রকল্পের গতি কমে যাওয়ায় ইস্পাত খাতের ব্যবসা অর্ধেক কমে গেছে। এর মধ্যে ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি ও ব্যাংকঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ায় ইস্পাত খাতের কোম্পানিগুলো ৪০ শতাংশের বেশি মূলধন হারিয়েছে। এ অবস্থায় ব্যবসার ক্ষতি পোষাতে ব্যাংকঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় চেয়েছে ইস্পাতশিল্পের মালিকেরা। পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ে অবকাঠামো উন্নয়নকাজে গতি আনারও দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
রাজধানীর পল্টনে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) কার্যালয়ে আজ মঙ্গলবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানান ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা। ইস্পাত খাতের তিন সংগঠন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ), বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ স্টিল মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
সংবাদ সম্মেলনে ইস্পাত ব্যবসায়ীরা বলেন, সরকারি অবকাঠামো উন্নয়নকাজের গতি একেবারে কমে গেছে। নতুন কোনো মেগা প্রকল্পের কাজও হাতে নেওয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, মূলধনের ঘাটতি, ব্যাংকঋণের বাড়তি সুদহার ও গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যায় ইস্পাত শিল্প খাত এখন বড় ধরনের অস্তিত্বসংকটে পড়েছে।
বিএসএমএর সাবেক সভাপতি মানোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ স্টিল মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহান, বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুবুর রশিদ এবং বিএসএমএর সাধারণ সম্পাদক সুমন চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মুহাম্মদ শহিদউল্লাহ, সহসভাপতি মো. আবদুস সালাম ও মারুফ মহসিন প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিএসএমএর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেখ মাসাদুল আলম।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত কয়েক বছরের অর্থনৈতিক নানামুখী সংকটের কারণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই দেশের বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণকাজের গতি কমে যায়। আর আগস্টে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই গতি আরও কমে গেছে। এতে বড় ধরনের সংকটে পড়েছে ইস্পাতশিল্প ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতগুলো। গত কয়েক মাসে ইস্পাত খাতের পণ্য বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এ ছাড়া ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদের কারণে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর চলতি মূলধনও ৪০ শতাংশের মতো কমেছে। লোকসানের ধাক্কা সামাল দিতে না পেরে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হওয়ার পথে রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুমন চৌধুরী বলেন, ইস্পাতশিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। গত আড়াই বছরে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে ১২০–১২৫ টাকা হয়েছে। এতে ইস্পাতশিল্পের চলতি মূলধন ৪০ শতাংশ কমে গেছে। মূলধন ঘাটতির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের দায় পরিশোধ করতে পারছে না এবং খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো চলতি মূলধনসীমাও কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে সব মিলিয়ে বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি এ খাত।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা চেয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে এ খাতে বাড়তি ঋণের যে দায় তৈরি হয়েছে, তা নিয়মিত ব্যাংকঋণের বাইরে রেখে ১৬ বছরে কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া। যেখানে ঋণ পরিশোধের রেয়াতি সময় বা গ্রেস পিরিয়ড থাকবে দুই বছর। এরই মধ্যে পুনঃ তফসিল হওয়া ও বিলম্বিত ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সুবিধা চেয়েছেন ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা। সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, ইস্পাতশিল্পের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা বর্তমানে মূলধনের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ পান। চলতি মূলধন ঘাটতি দূর করতে এই সীমা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো উচিত।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, ইস্পাত খাতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদন ব্যয় হয় জ্বালানি খাতে। বিগত সরকার দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী, পণ্যের দাম বাড়েনি। আবার বাড়তি দাম দিয়েও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস–বিদ্যুৎ পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি গুণগত মান (সিএম) সনদের বার্ষিক মাশুল ১৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এটিও শিল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইস্পাত ব্যবসায়ীরা আরও জানান, সম্প্রতি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির (ইপিএ) জন্য জাপান ও চীনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। দেশগুলো এ জন্য ইস্পাত পণ্যেরও শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের প্রস্তাব করেছে। ব্যবসায়ীরা বলেন, এমনিতেই দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি ইস্পাত পণ্য আমদানির সুযোগ থাকায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন এফটিএ বা ইপিএর আওতায় শুল্কমুক্ত ইস্পাত আমদানি–সুবিধা দেওয়া হলে দেশীয় ইস্পাত খাতে ধস নামবে।