মার্কিন ডলারের জোগান বাড়াতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাজেট সহায়তা ছাড়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। আগের সরকারের আমলেও বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে ১২০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছিল।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথম তিন মাসে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এনবিআর) কাছে নতুন করে ১৫০ কোটি ডলারের বাজেটে সহায়তা চেয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাজেট সহায়তা পাওয়ার পাইপলাইন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে ২৭০ কোটি ডলার, যা বর্তমান বাজারদরে দেশের সাড়ে ৩২ হাজার কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)। এর মধ্যে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে পাওয়া যাবে অর্ধেকের বেশি, যা পরিমাণে ১৭০ কোটি ডলার বা সাড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ পাওয়া গেলে তা হবে বিগত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
দাতারা প্রকল্প সহায়তার পাশাপাশি বাজেট সহায়তাও দিয়ে থাকে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে বিনিয়োগ হিসেবে সহায়তা দেয় তারা। এ ছাড়া সরকারকে অনেকটা নগদ অর্থ হিসেবে বাজেট সহায়তা দেয়। এ জন্য অবশ্য নানা ধরনের সংস্কারের শর্তও দিয়ে থাকে দাতারা।
দেশে দুই বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ চাপে রয়েছে। নিয়মিত আমদানি বিল পরিশোধ করতে গিয়ে ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমছে। সে জন্য ডলারের জোগান বাড়িয়ে রিজার্ভ শক্তিশালী করতে বাজেট সহায়তা পেতে আগ্রহী বর্তমান সরকার। এক-দেড় বছর ধরে ডলার প্রাপ্তির প্রধান উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ে বড় কোনো উল্লম্ফন নেই। তা কখনো বাড়ে, আবার কখনো কমে। দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি খাতের পড়ে থাকা বকেয়া এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থার বড় বড় আমদানি বিল বকেয়া পড়ে আছে। এসব বিল পরিশোধ করতেও বিপুল পরিমাণ ডলার প্রয়োজন।
ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভকে সুরক্ষিত রাখতে বাজেট সহায়তাকে আরেকটি উৎস হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার। সাধারণত বাজেট সহায়তা বাবদ ঋণ অনুমোদনের দুই সপ্তাহের মধ্যে তা বাংলাদেশের হাতে এসে পৌঁছায়।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে সরকারের নগদ ডলার দরকার। ভারতের আদানি গ্রুপের ৮০ কোটি ডলার বকেয়া পড়ে গেছে। বিভিন্ন সরকারি সংস্থার বড় বড় আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তাই বাজেট সহায়তার বিকল্প নেই। কারণ, এতে রিজার্ভ সুরক্ষিত রাখতে হবে। রিজার্ভ কমে গেলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের কিস্তি আটকে যেতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, বাজেট সহায়তার ইতিবাচক দিক হলো, নগদ ডলারের অজুহাতে বর্তমান সরকার সংস্কারের শর্ত পূরণ করতে পারবে।
কে কত দেবে
গত জুন মাসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিটের (ডিপিসি) আওতায় শেষ কিস্তির ২৫ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পেয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায়ের আগে ডিপিসির দ্বিতীয় পর্যায়ের বাজেট সহায়তা হিসেবে ৫০ কোটি ডলার চায়। আগামী মাসে এ সহায়তা অর্থ ছাড় করবে বিশ্বব্যাংক।
নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার এক মাসের মাথায় নতুন করে ১০০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা চেয়ে বিশ্বব্যাংককে চিঠি দিয়েছে। তবে বাজেট সহায়তা নিয়ে এখনো দর-কষাকষি চূড়ান্ত হয়নি। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এই ঋণ পেতে তিনটি শর্ত পালন করতে হবে বাংলাদেশকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, বেসরকারি খাতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে খেলাপি ঋণের নতুন সংজ্ঞায়ন করা ও নবগঠিত টাস্কফোর্সের নিরীক্ষা কার্যক্রমের বিবরণী বিশ্বব্যাংকের কাছে পেশ করার শর্ত মানতে হবে বাংলাদেশকে।
কবে নাগাদ এই অর্থ মিলবে, সেই সময়সীমা ঠিক হয়নি। তবে এই অর্থ নগর ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক খাতের সংস্কারে খরচ করা হবে বলে জানা গেছে।
বাজেট সহায়তা হিসেবে বিশ্বব্যাংকের কাছে ১৫০ কোটি ডলার চেয়েছে বাংলাদেশ।
এডিবির সঙ্গে কিছুটা ভিন্নভাবে বাজেট সহায়তা কর্মসূচিতে আছে বাংলাদেশ। তিন বছর ধরে এ কর্মসূচি চলছে। উপকূলীয়, হাওরসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানই বাজেট সহায়তার মূল্য লক্ষ্য। এ কর্মসূচির আওতায় আগামী ডিসেম্বর মাসে সংস্থাটি ৪০ কোটি ডলার দিতে পারে।
এডিবির কাছ থেকে বাজেট সহায়তা পেলে অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে ২০ কোটি ডলার এবং কোরিয়ার কাছ থেকে ১০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা মিলবে।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, এডিবির সঙ্গে আরেকটি বাজেট সহায়তা কর্মসূচিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে ৫০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা চেয়েছে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মূলত এলডিসি থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতে এই অর্থ খরচ করা হবে। আগামী মার্চ মাসে এই অর্থ ছাড় হতে পারে।
এসব বাজেট সহায়তার বাইরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে বাড়তি ৩০০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। অবশ্য এই বাড়তি ঋণ নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়নি আইএমএফ। বর্তমানে আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি আছে। এর মধ্যে তিন কিস্তিতে ২৫০ কোটি ৭৩ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।
ইআরডির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংক ও এডিবি আমাদের দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহযোগী। দেশের অর্থনীতির সক্ষমতা সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা আছে। আমরা কখনো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইনি। তাই বাজেট সহায়তার পরিমাণ বাড়ালেও কোনো ঝুঁকি নেই।’ উন্নয়ন সহযোগীরা বাজেট সহায়তার অর্থ দ্রুত ছাড় করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
৫ বছরে এসেছে ৭০০ কোটি ডলার
কোভিড মহামারি শুরু হওয়ার পর গত কয়েক বছরে এডিবি, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন ঋণদাতা সংস্থার কাছে অন্তত ৭০০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা এসেছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫০ কোটি ডলার পাওয়া গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৭৭ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা দিয়েছে দাতারা। সবচেয়ে বেশি বাজেট সহায়তা এসেছে ২০২১-২২ অর্থবছরে। ওই বছরে পাওয়া গেছে ২৬০ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০৯ কোটি ডলার এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০০ কোটি ডলার এসেছে।