গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার পতনের কারণে বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম কমেছে, তবে চালের দাম উল্টো বেড়েছে। মাসখানেক ধরে খাদ্যপণ্যটির দাম বাড়ছে। সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা ব্যবসায়ীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে, এবং তারা বানের অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। উৎপাদন এলাকা উত্তরের জেলা ছাড়াও কুষ্টিয়ায় চালের দাম চড়েছে। গত এক মাসে পাইকারি বাজারে ৫০ কেজির বস্তার দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, এবং খুচরা বাজারে প্রতি কেজিতে ৩-৪ টাকা বেড়েছে।
ক্রেতারা মনে করছেন, সরকারের পতনের পর চালের সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তা হয়নি। তদারকির অভাবে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আরও সক্রিয় হয়ে মুনাফা করছে। রংপুরের সিটি বাজারের রিকশাচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়াচ্ছেন। নতুন সরকার যদি সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারে, তবে খাদ্যাভাবের শিকার হতে হবে।
ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, চালের বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই। তারা জানান, পূর্বাঞ্চলের বন্যার কারণে সরকারি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন গুদামের শত শত টন চাল নষ্ট হয়ে গেছে। লাখ লাখ পরিবারের সঞ্চিত চাল পানির নিচে চলে গেছে। ত্রাণ হিসেবে বড় পরিমাণ চাল বিতরণ করা হচ্ছে, ফলে মোটা ও মাঝারি ধরনের চালের চাহিদা বেড়েছে। ঢাকাসহ কয়েকটি জেলা থেকে ক্রয়ের সুযোগে মিল মালিক ও মজুতদাররা দাম বাড়িয়েছে। তদারকি না থাকায় তারা অতিরিক্ত মুনাফা করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ধানের গুদামে অভিযান এবং চাল আমদানির পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
মিলারদের মতে, বর্তমানে ধানের সংকট রয়েছে এবং মজুত চালও ফুরিয়ে এসেছে। লাইসেন্সবিহীন ধান ব্যবসায়ীদের আধিপত্যের কারণে মিল পর্যায়ে কেজিতে ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা বেড়েছে। মিলাররা সামান্য লাভ পেলেও খুচরা ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন।
কুষ্টিয়ার চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান জানান, মিলাররা যে চাল ৬৪-৬৫ টাকায় বিক্রি করছেন, তা করপোরেট প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত করে প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছে। সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পাশাপাশি আমন ওঠার আগ পর্যন্ত চাল আমদানির পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা ও উৎপাদন এলাকায় চালের দাম প্রায় সমান। মাঝারি আকারের বিআর-২৮ এবং পাইজাম চাল সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মহাখালী কাঁচাবাজারে বিআর-২৮ চালের কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা মাসখানেক আগে ছিল ৫৪-৫৮ টাকা। মোটা চালের দাম ৫০-৫৪ টাকা থেকে বেড়ে ৫২-৫৫ টাকা হয়েছে। মাঝারি ও মোটা চাল কেজিতে ১ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম ২-৪ টাকা বেড়ে ৬৪-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ইত্যাদি জেলায় ভয়াবহ বন্যার কারণে চাল, চিড়া, মুড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
রংপুর অঞ্চলে মোটা চালের কেজি ৫৫ টাকা ছাড়িয়েছে। মান অনুযায়ী ৫০ কেজির বস্তায় দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। খুচরায় কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৬ টাকা। রংপুর সিটি বাজার, সিও বাজার, লালবাগ বাজারে স্বর্ণা ও ব্রি-২৯ জাতের মোটা চাল ৫৫-৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা কয়েকদিন আগে ছিল ৫০ টাকার আশেপাশে। মাঝারি মানের চাল ৬২ টাকা থেকে বেড়ে ৬৪-৬৫ টাকা হয়েছে, এবং চিকন চাল ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রংপুর জেলা মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন, অটো রাইস মিলের মজুত কমেছে। বন্যায় কুমিল্লা ও ফেনীতে বড় আড়তের হাজার হাজার টন চাল নষ্ট হয়েছে, যার প্রভাব বাজারে পড়েছে।
কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামে কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। মিলগেটে মান অনুযায়ী সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৬৭ টাকায়। মিল মালিকরা জানান, বন্যার কারণে বাজারে ধানের সরবরাহ কমে যাওয়ায় মণপ্রতি দাম বেড়ে ২০০ টাকা হয়েছে। কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শারমিন আক্তার বলেন, ধানের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে চালের দাম বাড়লে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং অসাধু মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি শহিদুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, চালের চাহিদা বেড়েছে, তবে ধানের মজুত ফুরিয়ে এসেছে। এজন্য মোটা চালের দাম বেড়ে গেছে। তবে শিগগির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
টিসিবির তথ্যে, গত এক মাসে মাঝারি ও মোটা চালের দাম প্রায় ৩ শতাংশ এবং সরু চালের দাম ৪ শতাংশ বেড়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুফল ভোক্তারা পাচ্ছেন না। অধিদপ্তর শিগগির বাজার তদারকি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।