শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ করতে এসে আর কোনো বিনিয়োগকারী যাতে এই বাজার থেকে নিঃস্ব হয়ে ফেরত না যান, সে জন্য বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তি থেকে শুরু করে কোম্পানি তালিকাচ্যুত করা, কারসাজির ঘটনায় জরিমানা, আইন ও নীতি সংস্কার—এসব কিছু করতে হবে বিনিয়োগকারীর সর্বোচ্চ সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে।
গত ১৫-২০ বছরে খারাপ কোম্পানির তালিকাভুক্তি, মিউচুয়াল ফান্ডের অনিয়ম, কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ফ্লোর প্রাইস আরোপ, কিছু ব্রোকারেজ হাউসের অর্থ আত্মসাৎ, ভুয়া আর্থিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহসহ নানা অনিয়মে ঘুরেফিরে বিনিয়োগকারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভবিষ্যতে যাতে এসব ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব সংস্কার ও নীতি প্রণয়নে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে।
দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্রোকারেজ হাউসমালিকদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) আয়োজিত এক সেমিনারে এসব প্রস্তাব উঠে আসে। আজ শনিবার সকালে রাজধানীর ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী মিলনায়তনে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
ডিবিএ আয়োজিত এই সেমিনার ছিল কিছুটা ভিন্নধর্মী। সাধারণত বিভিন্ন সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। তবে ডিবিএ আয়োজিত এই সেমিনারে মূল আলোচক ছিলেন গণমাধ্যমে কর্মরত পুঁজিবাজারবিষয়ক সাংবাদিকেরা। কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁরা বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন এবং এসব সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ, বিনিয়োগকারীবান্ধব ও শক্তিশালী পুঁজিবাজার গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। স্টক এক্সচেঞ্জের পাশাপাশি ব্রোকারেজ হাউস, তালিকাভুক্ত কোম্পানি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিসহ বাজারসংশ্লিষ্ট কারও পদক্ষেপে যেন বিনিয়োগকারীরা বড় ক্ষতির মুখে না পড়েন, তাঁরা তা নিশ্চিত করতে বলেন।
শেয়ারবাজারবিমুখ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাজারমুখী করতে সরকারের পাশাপাশি প্রধানতম নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিএসই, ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ সব বাজার মধ্যস্থতাকারীর মধ্যে নীতি সংস্কারের পাশাপাশি মানসিকতারও সংস্কার প্রয়োজন বলে মত দেন আলোচকেরা।
ডিবিএর সভাপতি মো. সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে অতিথি ছিলেন ডিএসইর চেয়ারম্যান মো. মমিনুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেন পুঁজিবাজারবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের (সিএমজেএফ) সাবেক সভাপতি জিয়াউর রহমান, তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু, বর্তমান সভাপতি গোলাম সামদানী, ইংরেজি দৈনিক ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের বিশেষ প্রতিনিধি দৌলত আক্তার মালা, প্রথম আলোর বাণিজ্য সম্পাদক সুজয় মহাজন, সিএমজেএফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন, সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার আনোয়ার ইব্রাহীম, ইংরেজি দৈনিক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের বিশেষ প্রতিনিধি জেবুন নেসা আলো, ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার আহসান হাবিব, একাত্তর টিভির বিশেষ প্রতিনিধি সুশান্ত সিনহা ও বণিক বার্তার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেদী হাসান রাহাত। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন ডিবিএর সিনিয়র সহসভাপতি মো. সাইফউদ্দিন।
সেমিনারে ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে শেয়ারবাজারে দুষ্টের পালন আর শিষ্টের দমন করা হয়েছে। সব কটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ডিএসইকে পরিণত করা হয়েছে একটি পোস্ট বক্সে। ফলে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ অরক্ষিত থেকেছে। বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারের সংস্কারের সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায়। সব আইনকানুন ও নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের রাখতে হবে কেন্দ্রবিন্দুতে। তাহলে বাজারের প্রতি আস্থা ফিরে পাবেন বিনিয়োগকারীরা, তাঁদের বিনিয়োগও সুরক্ষা পাবে।
শেয়ারবাজারকে ফুটবল খেলার সঙ্গে তুলনা করে মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এই বাজারে ডিএসইর রেফারির ভূমিকা নেওয়ার কথা। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা হওয়ার কথা ছিল ফিফার ভূমিকা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বিগত ১৫ বছরে শেয়ারবাজারে রেফারির ভূমিকা পালন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সক্ষমতার ওপর দাঁড়াতে পারেনি। শেয়ারবাজারে নানা ধরনের অনিয়ম ও কারসাজির ঘটনা ঘটলেও বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে। এ অবস্থা থেকে এখন আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’
মমিনুল ইসলাম আরও বলেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে স্বল্প মেয়াদি ব্যবস্থা যেমন লাগবে, তেমনি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। কাঠামোগত সংস্কারের মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। যেকোনো অনিয়ম ও কারসাজির ঘটনায় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে এখন থেকে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির পরিমাণকে সবার আগে বিবেচনায় নিতে হবে।
শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তি করা ও করকাঠামোতে যেসব অসংগতি রয়েছে, সেগুলো দূর করতে ডিএসই কাজ করছে বলেও জানান প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিদ্যমান সমস্যা থেকে বেরিয়ে বাজার একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াবে।
ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীজুড়েই শেয়ারবাজার অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি। কিন্তু বাংলাদেশে নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে এ স্বীকৃতি পাওয়া যায় না। পুঁজিবাজার যে অর্থনীতির শক্তিশালী একটি খাত, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে সেই স্বীকৃতি দিতে হবে। বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বাজার মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে সংস্কার ও পুঁজিবাজার নিয়ে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সেই প্রত্যাশা পূরণে কাজ করতে হবে।
এ সময় তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ সব বাজার অংশীজনের মানসিকতা ও নীতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে যদি খারাপ কোম্পানি বাজারে আসার বিষয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি, তাহলে আগামী দিনে কোনো কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করতে পারবে না। একই সঙ্গে ব্রোকারেজ হাউসগুলোকেও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় সচেষ্ট থাকতে হবে।’
সেমিনারে আলোচনায় অংশ নিয়ে সাংবাদিকেরা পুঁজিবাজারের বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, অতীতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সহায়তায় ভুয়া আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে শত শত কোটি টাকা নামসর্বস্ব কিছু কোম্পানি বাজার থেকে লোপাট করেছে। এসব কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখাতে কাজ করেছে কিছু নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই দুর্বল মানের এসব কোম্পানি ও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
সাংবাদিকেরা আরও বলেন, ঋণাত্মক ঋণ হিসাব বা নেগেটিভ ইক্যুইটি এবং মার্জিন ঋণ বাজারের জন্য ক্যানসারে রূপ নিয়েছে। এই দুই বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশি–বিদেশি ভালো কোম্পানি বাজারে আনতে প্রয়োজনে আইনি ছাড় ও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণেরও পরামর্শ দেন সাংবাদিকেরা। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশে কর্মরত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনা গেলে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়বে এবং খারাপ শেয়ারের বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রবণতাও কমবে।
এ ছাড়া শেয়ারবাজারে মন্দ কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করার বিধান কার্যকর করা, ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত করতে কর–সুবিধাসহ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা, সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে শেয়ারবাজারকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
সেমিনারে কয়েকজন সাংবাদিক বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেন। কোম্পানির তালিকাভুক্তির সময় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে এবং কারসাজির ঘটনায় দায়ীদের যে জরিমানা করা হয়, তার একটি অংশ দিয়ে এই সুরক্ষা তহবিল গড়ে তোলা যেতে পারে। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের হিসাব খোলা ও লেনদেন সহজ করতে মুঠোফোননির্ভর সেবা চালুর সুপারিশ করা হয়। স্বল্প মূলধনি বা কম পুঁজির কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির মাধ্যমে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা রোধে সার্কিট ব্রেকার বা মূল্যসীমা তুলে দেওয়া এবং শর্টসেল ব্যবস্থা চালু করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারে তারল্যসংকট দূর করা, মিউচুয়াল ফান্ড খাতকে সক্রিয় করা এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে নিযুক্ত স্বতন্ত্র পরিচালকদের জবাবদিহি ও তাঁদের মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিতে প্রয়োজনে আইনি সংস্কারের সুপারিশ করেন সাংবাদিকেরা।