লক্ষ্মীপুরের মানুষের কাছে গত ৪ আগস্ট রাত ছিল অন্য রকম। ওই দিন সন্ধ্যার পর শহরে খবর ছড়িয়ে পড়ে—এ কে এম সালাহ উদ্দিন ওরফে টিপু পালিয়েছেন। প্রথমে কেউই বিশ্বাস করতে পারেননি। প্রশাসন আর থানা-পুলিশ যাঁর কথায় নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তি পালাবেন! এরপর প্রায় দুই মাস কেটে গেছে। আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সদর উপজেলা পরিষদের তিনবারের চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিনকে।
একসময়ের ‘সন্ত্রাসের জনপদ’ হিসেবে পরিচিত লক্ষ্মীপুর এখন অনেকটা শান্ত। এত দিন চুপ থাকা মানুষগুলো জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সালাহ উদ্দিনের বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। তাঁরা বলছেন, সালাহ উদ্দিনের উত্থান ‘তাহের–পুত্র’ হিসেবে। তাঁর ও তাঁর পরিবারের ইশারায় আবর্তিত হয়েছে লক্ষ্মীপুরের রাজনীতি। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁরা বিপুল সম্পদেরও মালিক হয়েছেন।
সালাহ উদ্দিন ও তাঁর পরিবার দলের ত্যাগী নেতা ও সাধারণ মানুষকে এত দিন জিম্মি করে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল আমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাদের যে এত ক্ষমতা, তার মূলে ছিলেন লক্ষ্মীপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র প্রয়াত আবু তাহের। তাহের মারা
যাওয়ার পর তাঁরা ঘিরে ছিলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) নুর উদ্দিন চৌধুরীকে। তিনি (নুর উদ্দিন) সালাহ উদ্দিনের মামাতো বোনের স্বামী।
দলীয় সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী ক্ষমতায় আসার পর আবু তাহের জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় সারা দেশে আলোচনায় আসেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর তাহের, তাঁর স্ত্রী, এক ছেলে খুনসহ বিভিন্ন মামলায় কারাগারে ছিলেন। পরে জামিনে মুক্তি পান। ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁরা পলাতক ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর তাহের পরিবার লক্ষ্মীপুরে ফিরে আসে। তাহের আওয়ামী লীগের সমর্থনে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন।
বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন বলে দাবি করেছেন এ কে এম সালাহ উদ্দিন। গত শনিবার মেসেঞ্জারে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রদের ওপর আমি গুলি করিনি। গুলি করেছি ওপরের দিকে। আত্মরক্ষার্থে ও পরিবার–পরিজনকে হেফাজতের জন্য গুলি করেছি। রাজনৈতিকভাবে আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছি, এ কারণে দলের ভেতরের ও বাইরের লোকজন অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি কোনো অপকর্মে জড়িত ছিলাম না।’
গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। মাথায় হেলমেট। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। এমন সাজে বাড়ির ছাদে অবস্থান নিয়ে গুলি ছুড়ছেন সালাহ উদ্দিন। মাঝেমধ্যে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন নেতা-কর্মীদের। হাসছেন, আবার গুলি ছুড়ছেন। একই ছাদে তাঁর সঙ্গে আরও ২০–২৫ জনের অবস্থান। তাঁদের অনেকের হাতে অস্ত্র। ছাদেই ড্রামের মধ্যে বানানো হচ্ছে শরবত, পান করে আবার গুলি করেন তাঁরা। লক্ষ্মীপুর শহরের সালাহ উদ্দিনের পৈতৃক বাড়ি পিংকি প্লাজা থেকে গত ৪ আগস্ট এভাবেই টানা ৪ ঘণ্টা আন্দোলনকারী ছাত্র–জনতার ওপর গুলি করা হয়। এর আগে আন্দোলনকারীদের ধাওয়ায় নেতা-কর্মীদের নিয়ে বাড়ির ছাদে অবস্থান নেন সালাহ উদ্দিন। এরপর বেলা ১১টা থেকে কিছুক্ষণ পরপর সড়কে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের লক্ষ করে গুলি করেন সালাহ উদ্দিনসহ তাঁর বাহিনী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে ওই দিন সংঘর্ষে পুরো লক্ষ্মীপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
ওই দিন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আন্দোলনকারীরা সালাহ উদ্দিনের চারতলা বাসভবন ও পাঁচতলা আরেকটি ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। সারা দিনে নিহত হন চার শিক্ষার্থীসহ ১২ জন। যার মধ্যে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরাও ছিলেন। ওই ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী সাদ আল আফনান ও সাব্বির হোসেন হত্যা মামলায় সালাহ উদ্দিনকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
ওই দিনের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ মো. রবিন ও হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, সালাহ উদ্দিনের অনবরত গুলির কারণে সেদিন হাসপাতালে এক ভয়াবহ চিত্র ছিল। সারি সারি গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী। শত শত মানুষের জটলা, চিৎকার। কারও হাতে, কারও পায়ে, কারও কোমরে, কারও পিঠে গুলির চিহ্ন। পুরো হাসপাতালের কোথাও ঠায় ছিল না।
ওই দিন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আন্দোলনকারীরা সালাহ উদ্দিনের চারতলা বাসভবন ও পাঁচতলা আরেকটি ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। সারা দিনে নিহত হন চার শিক্ষার্থীসহ ১২ জন। যার মধ্যে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরাও ছিলেন। ওই ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী সাদ আল আফনান ও সাব্বির হোসেন হত্যা মামলায় সালাহ উদ্দিনকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের জে এম শাখার তথ্যমতে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত জেলা প্রশাসন ব্যক্তিমালিকানা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করে ৩৫টি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হলে জেলার বিভিন্ন থানায় ৩৪টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা পড়ে। শুধু এ কে এম সালাহ উদ্দিনের নামে থাকা অস্ত্রটি জমা পড়েনি।
নিহত শিক্ষার্থী সাদ আল আফনানের মামা ষাটোর্ধ্ব হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সালাহ উদ্দিন বাহিনী গুলি করে আমার একমাত্র ভাগিনাটাকে মেরে ফেলেছে। জোয়ান ছেলেডারে এইভাবে কবর দিতে হবে, জীবনে ভাবতেও পারিনি।’
লক্ষ্মীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াছিন ফারুক মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত করে সেই দিন। গুলিবর্ষণ ও হত্যার ঘটনা তদন্ত হচ্ছে।
সালাহ উদ্দিন বাহিনী গুলি করে আমার একমাত্র ভাগিনাটাকে মেরে ফেলেছে। জোয়ান ছেলেডারে এইভাবে কবর দিতে হবে, জীবনে ভাবতেও পারিনি।
নিহত শিক্ষার্থী সাদ আল আফনানের মামা ষাটোর্ধ্ব হারুনুর রশিদ
ভোট এলেই কদর বাড়ে
জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের সময় এলেই লক্ষ্মীপুরে এ কে এম সালাহ উদ্দিন ও তাঁর বড় ভাই এ এইচ এম আফতাব উদ্দিনের (বিপ্লব) গুরুত্ব বেড়ে যেত। নিজেদের বাহিনী নিয়ে তাঁরা টাকার বিনিময়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার, কেন্দ্র দখল, ব্যালটে সিল মারার কাজ করে দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিল। এ কারণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ঝুঁকিতে ছিলেন। ভোটের এক দিন আগে ওই প্রার্থী কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার ও ব্যালট পেপার সিল মারার জন্য সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে সমঝোতা করেন। এ জন্য তাঁকে নগদ ৩ কোটি টাকা দিয়েছেন। এরপর সালাহ উদ্দিন তাঁর বাহিনী নিয়ে রাতেই অনেক কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালটে সিল মেরে রাখেন। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর আরও টাকা দিতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাবেক দুজন মেয়র ও দুজন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, নির্বাচনের দিনের জন্য তাঁরা সালাহ উদ্দিন বাহিনীর শরণাপন্ন হয়েছেন। মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন। এই বাহিনী পক্ষে থাকলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন। এতে বিজয় মোটামুটি নিশ্চিত ছিল।
গত ২৮ এপ্রিল সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউপির নির্বাচন ছিল। ১৮ এপ্রিল আফতাব উদ্দিন প্রভাব বিস্তারের জন্য ওই ইউনিয়নে যান। তবে চেয়ারম্যান প্রার্থী ওমর ফারুক ইবনে হুছাঈনের নির্বাচনের প্রচারণা চালাতে গিয়ে জনরোষে পড়েন। রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে প্রাণভিক্ষা পাওয়া ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আফতাব উদ্দিন তেওয়ারীগঞ্জ বাজারে দেওয়া বক্তব্য বলেন, ‘কেউ ভয় পাবেন না। ধৈর্য ধরেন। আমার চেয়ে খারাপ লোক এ জেলাতে হয় নাই, হবেও না।’
বিএনপির নেতা নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন আফতাব উদ্দিন। ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই এই দণ্ড মওকুফ করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। পরের বছর আরও দুটি হত্যা মামলায় (কামাল ও মহসিন হত্যা) আফতাবের যাবজ্জীবন সাজা কমিয়ে ১০ বছর করেন রাষ্ট্রপতি। এরপর রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১২ সালে ফিরোজ হত্যা মামলা থেকেও তাঁর নাম প্রত্যাহার করা হয়।
সেসব নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি বিচার। সালাহ উদ্দিনের কারণেই এখন আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মী এলাকাছাড়া।
আবুল কাশেম চৌধুরী
‘তাহের স্টাইলে’ নির্বাচন
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আসার পর লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) হন এ কে এম সালাহ উদ্দিন। তখন তাঁর বাবা আবু তাহের জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০১ সালে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতিও হন সালাহ উদ্দিন। ২০১৪ সালে সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী হন সালাহ উদ্দিন। নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক মহিউদ্দিন বকুল বিদ্রোহী প্রার্থী হন। অনুরোধ, জোর খাটানো, হুমকি, তদবির ও অর্থ ব্যয় করে জেলা যুবলীগের তৎকালীন যুগ্ম আহ্বায়ক সালাহ উদ্দিন নির্বাচনী বৈতরণি পার হন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ওই নির্বাচনের বিষয়ে মহিউদ্দিন বকুল আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ওই সময় সালাহ উদ্দিনকে বিজয়ী করে আনতে মরিয়া ছিলেন আবু তাহের। সে জন্য ‘তাহের স্টাইলে’ সবই করছেন তিনি। সালাহ উদ্দিন ও তাহেরের সন্ত্রাসী বাহিনী র্যাবের সহযোগিতায় সারা রাত তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে রাখে। বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি। এ সুযোগে রাতেই ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে তাঁর বাহিনী। মহিউদ্দিন বকুল বলেন, ‘বাসার ভেতরে ঢুকে সন্ত্রাসীরা রাইফেল দিয়ে আমার বুক ও শরীরে অসংখ্য আঘাত করে। এতে ওই সময় লিভার প্রচণ্ডভাবে জখম হয়। এরপর থেকেই অসুস্থ জীবনযাপন করছি।’
২০১৮ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় আবুল কাশেম চৌধুরীকে। এবার বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে মাঠে নামেন সালাহ উদ্দিন। আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, ভোটের আগে কয়েকটি এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দিয়েছেন তাহের বাহিনীর সদস্যরা। এই মহড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখেছে। তবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাঁদের হুমকির মুখে দলের অনেক কর্মী এলাকা ছেড়ে গেছেন। ‘তাহের স্টাইলে’ নির্বাচন হয়েছে।
আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, ‘সেসব নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি বিচার। সালাহ উদ্দিনের কারণেই এখন আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মী এলাকাছাড়া।’
সর্বশেষ চলতি বছরে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সালাহ উদ্দিনের বিপক্ষে মাঠে কোনো শক্তিশালী প্রার্থীই ছিলেন না। ঢিলেঢালা ওই নির্বাচনে তিনি প্রায় ৭০ হাজার ভোট পান। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী রহমত উল্যাহর ভোটের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৩৯৭।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এসবের বাইরেও সম্পদ রয়েছে সালাহ উদ্দিনের। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে জমি, অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে তাঁর। তিনি সম্পদের একটি অংশ করেছেন স্ত্রী, কন্যা ও বেনামে।
প্রভাব খাটিয়ে জমি দখল
প্রভাব খাটিয়ে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে কখনো নামমাত্র মূল্যে, আবার কখনো গায়ের জোরে সালাহ উদ্দিন পরিবার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে অনেক জমি দখল করে বলে অভিযোগ রয়েছে। টেবিলের ওপর অস্ত্র রেখে জমি লিখে নেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা মামলা করার সাহস পাননি।
লক্ষ্মীপুর পৌর এলাকার ইটের পোল এলাকায় একটি বাগানবাড়ি করে তাহের পরিবার। ২০৮ শতাংশ জমির ওপরের বাগানবাড়িতে সাতটি হরিণ, ময়ূরসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ছিল। তাদের রাখার জন্য ছিল পাঁচটি শেড। তাহেরের তিন ছেলে সালাহ উদ্দিন, আফতাব উদ্দিন ও আবু শাহাদাত মো. শিবলু সেই বাগানবাড়িতে মাঝেমধ্যে গিয়ে সময় কাটাতেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বাগানবাড়িটি তছনছ করে দেন স্থানীয় লোকজন। হরিণ, ময়ূরসহ প্রাণীগুলো লুট করা হয়। শেডগুলো ভেঙে ফেলে।
ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সালাহ উদ্দিন পরিবার ২০৮ শতক জমি দেয়াল দিয়ে দখলে নিয়ে বাগানবাড়ি গড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, ওই ১০০ বছর আগে তাঁর দাদা মনসুর আলী ভূঁইয়া ক্রয়সূত্রে জমির মালিক হন। ১০ বছর আগে আবু তাহের তাঁদের পাশে এক ব্যক্তির কাছ থেকে অল্প কিছু জমে কেনেন। এরপর তাঁদের জমিগুলো দখলের পাঁয়তারা করেন। একপর্যায়ে দখল করে নেন। ওই সময় সালাহ উদ্দিন তাঁর বাহিনী দিয়ে তাঁকে কার্যালয়ে তুলে নিয়ে যান। টেবিলের ওপরে অস্ত্র রেখে জমি লিখে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। একপর্যায়ে গুলি করে হত্যার হুমকি দেন।
স্থানীয় একজন চায়ের দোকানদার বলেন, ইটের পোল এলাকা প্রতি শতক জমির দাম ৭ থেকে ১০ লাখ টাকা। সেই হিসাবে কয়েক কোটি টাকা জমি দখল করে বাগানবাড়ি গড়েছেন। এই বাগানবাড়িতে চিড়িয়াখানা করার পরিকল্পনা ছিল সালাহ উদ্দিনের পরিবারের।
মটবি দরবার শরিফের এলাকায় (মজুচৌধুরী হাটের কাছে) রিসাইকেল পার্ক করেন তাহের পরিবার। প্রায় ২৫০ শতক জমিতে এটি করা হয়। তাহেরের ছোট ছেলে আবু শাহাদাত মো. শিবলু এটির পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতা-কর্মীরা বলছেন, সালাহ উদ্দিনের পরিবার এখানকার জমি স্থানীয়দের কাছ থেকে অনেকটা জোর করে নিয়েছে। কেউ কেউ নামমাত্র মূল্য পেয়েছেন, আবার কেউ কেউ সেটাও পাননি। প্রচার আছে, সুসজ্জিত পার্ক নির্মাণে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
দলীয় নেতা-কর্মী, পুলিশের ওপরও হামলা
২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর জেলা যুবলীগের সম্মেলনে সালাহ উদ্দিন সভাপতি ও আবদুল্লাহ আল নোমান সাধারণ সম্পাদক হন। তবে তাঁরা চার বছরেও পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি করতে পারেননি। দুই নেতার কমিটি দিয়ে যুবলীগ চালানোর বিষয়ে দলের ভেতরে ক্ষোভ থাকলেও কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি। এমন অবস্থায় ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জেলা যুবলীগের বর্ধিত সভা ডাকা হয়। সভায় যোগ দিতে আসা কেন্দ্রীয় নেতাদের স্বাগত জানাতে রামগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর সড়কের পাশে দাঁড়ান পদপ্রত্যাশী নেতা-কর্মীরা। সেখানে সালাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়। হামলায় জেলা যুবলীগের সম্ভাব্য সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নুরুল আজিমসহ ১০ নেতা-কর্মী আহত হন। ওই ঘটনার জের ধরে জেলা যুবলীগের কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় কমিটি।
ঘটনার পর সৈয়দ নুরুল আজিম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, পরিকল্পিতভাবে তাঁদের ওপর হামলা হয়েছে। সালাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে ১০–১৫ জন মোটরসাইকেলে এসে এ হামলা চালান।
সালাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশে ওপর হামলা চালানোর অভিযোগও রয়েছে। ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যুবলীগের স্থানীয় কর্মী দেলোয়ার হোসেনের ওপর হামলা করে সালাহ উদ্দিন ও তাঁর লোকজন। বাধা দিলে তারা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। একপর্যায়ে পুলিশ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের ৪ সদস্যসহ অন্তত ১০ জন আহত হন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেলা যুবলীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। বর্তমানে মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে করছেন, অবস্থান এমন দুজন হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোকে বলেন, সালাহ উদ্দিনের দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ হতে চাইলে তাঁকে ‘তাহের স্টাইলে’ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হতো। নানাভাবে হেস্তনেস্ত করা হতো।
লাখপতি থেকে কোটিপতি
২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামায় সালাহ উদ্দিন তাঁর বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ২০২৪ সালের ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এসে তিনি বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ১৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এর মধ্যে কেবল বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট বা দোকানভাড়া দিয়েই তিনি বছরে ৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা আয় করতেন। ব্যবসা থেকে আয় ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
২০১৪ সালের তিনি অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছিলেন প্রায় ৩৬ লাখ টাকা। ২০২৪ সালে এসে সালাহ উদ্দিন তাঁর সম্পদের আর্থিক মূল্য দেখিয়েছেন প্রায় তিন কোটি টাকা। যদিও আগে যৌথ মালিকানার চারতলা একটি দালান ছাড়া কোনো স্থাবর সম্পদ ছিল না তাঁর।
চলতি বছরের (২০২৪ সালের) হলফনামা অনুযায়ী, সালাহ উদ্দিনের অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। এর মধ্যে নগদ টাকা ও বিভিন্ন স্থানে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। আগে কোনো স্থাবর সম্পদ না থাকলেও ২০২৪ সালে এসে তিনি ১ কোটি ৭২ লাখ টাকার স্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন। এর মধ্যে ১২ দশমিক ৭৫ শতক অকৃষজমি দেখিয়েছেন। যার অর্জনকালীন মূল্য ৭১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। লক্ষ্মীপুর নিউমার্কেটে ও পৌর আধুনি বিপণিবিতানে দোকান নিয়েছেন ৯ লাখ টাকায়। পিংকি প্লাজা নির্মাণে কয়েক দফায় বিনিয়োগ দেখিয়েছেন ২৩ লাখ ১১ হাজার টাকা। দুই শতক ও ২ দশমিক ৭৫ জমিতে দুটি ভবন নির্মাণের খরচ দেখিয়েছেন ৬৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা। শিল্পী কলোনিতে বাড়ি নির্মাণে ব্যয় দেখিয়েছেন ৭৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ঢাকায় ৪৫৬ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের মূল্য দেখিয়েছেন ১০ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এসবের বাইরেও সম্পদ রয়েছে সালাহ উদ্দিনের। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে জমি, অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে তাঁর। তিনি সম্পদের একটি অংশ করেছেন স্ত্রী, কন্যা ও বেনামে।
লক্ষ্মীপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি জেড এম ফারুকী বলেন, সালাহ উদ্দিনের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই। কিন্তু সম্পদ বেড়েই চলেছে। তাঁদের অনিয়ম ও দুর্নীতিগুলোর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান হওয়া উচিত।