বেলুচিস্তানে ২১ সন্ত্রাসী ও ১৪ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ নিহত ৭৩
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে আসা ২৩ বেসামরিক নাগরিককে বাস ও ট্রাক থেকে টেনে নামিয়ে আনা হয়েছিল এবং সশস্ত্র বন্দুকধারীরা তাদের পরিচয় জেনে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার ভোরে এই ঘটনা ঘটে। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ বেলুচিস্তানে গত রবিবার রাতে এবং গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত অন্তত ছয়টি প্রাণঘাতী হামলার একটি সিরিজ চলে। এই হামলাগুলোতে কমপক্ষে ৭৪ জন নিহত হয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং পাক ইনস্টিটিউট অফ পিস স্টাডিজ (পিআইপিএস) এর পরিচালক মুহম্মদ আমির রানা আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘গত বছরের মে মাসেও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বড় ধরনের হামলা হয়েছিল। পাঞ্জাবের কাছে মহাসড়ক অবরুদ্ধ করা হয়েছে, রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের আক্রমণের পরিসরও বেড়েছে। এর কারণ তারা পাঞ্জাবে বা কাছাকাছি অঞ্চলে সংঘাত বাড়িয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা করছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাঞ্জাব পাকিস্তানের বৃহত্তম, সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং সবচেয়ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী প্রদেশ। সেখানে কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এর আগে চীনা নাগরিক এবং বিভিন্ন প্রকল্পের ওপর এর আগে হামলা হয়। এর মধ্যে দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এই বার্তা পাঠাতে চায় যে, বেলুচিস্তানে বহিরাগতরা নিরাপদ নয়।
বেলুচিস্তান বিশেষজ্ঞ মালিক সিরাজ আকবর বলেছেন, ‘চীনারা ছাড়াও বেলুচ জাতীয়তাবাদীরাও নির্দিষ্ট গোষ্ঠী যেমন নিরাপত্তা বাহিনী, পাঞ্জাবি শ্রমিক এবং উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো, এই উন্নয়ন কাজে জড়িত গোষ্ঠীগুলোকে বেলুচিস্তানে আসতে নিরুৎসাহিত করা।
সাবেক জাতীয়তাবাদী নেতা নবাব আকবর বুগতির ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকীর সময় এই হামলার ঘটনাগুলো ঘটল। বুগতি বেলুচিস্তানের একজন সাবেক গভর্নর এবং মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ২০০৫ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যোগ দেন এবং ২০০৬ সালের আগস্টে তার নিজ শহর ডেরা বুগতির কাছে একটি সামরিক অভিযানে নিহত হন।
মালিক সিরাজ আকবর আল জাজিরাকে আরো বলেছেন, ‘বুগতির মৃত্যুবার্ষিকীর সময় ধারাবাহিক এই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।বেলুচিস্তানজুড়ে সাম্প্রতিক হামলা দেশটির সরকারকে স্পষ্ট একটি বার্তা দিয়েছে। তা হলো, ‘সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব সমগ্র প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, যা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’
২০২৩ সালের আদমশুমারি অনুসারে, পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ বেলুচিস্তান। দেশটির ২৪০ মিলিয়ন নাগরিকের মধ্যে প্রায় ১৫ মিলিয়নের আবাসস্থল এই প্রদেশ। তেল, কয়লা, সোনা, তামা এবং গ্যাসের বিশাল মজুদসহ প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও প্রদেশটি দেশের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চল হিসেবেই এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে।
বেলুচিস্তানে পাকিস্তানের একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দর গোয়াদর। ৬০ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকল্পের কেন্দ্রস্থল। যার লক্ষ্য দক্ষিণ-পশ্চিম চীন এবং আরব সাগরের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সংযোগ স্থাপন করা। প্রদেশটির অনেকেই পাকিস্তানি রাষ্ট্রকে তাদের চাহিদার দিকে নজর না দেওয়া এবং তাদের সম্পদ শোষণের অভিযোগ করেছে।
আকবর বলেন, ‘জাতীয়তাবাদীরা সোনা, খনিজ এবং কয়লা অনুসন্ধানের ঘোর বিরোধী। এই কার্যকলাপগুলোকে বেলুচিস্তানের সম্পদের শোষণ হিসেবে দেখেন তারা। প্রায়ই স্থানীয় জনগণের উপকার না করে সম্পদ আহরণের প্রমাণ হিসেবে প্রদেশটি থেকে ছেড়ে আসা কয়লা ট্রাকের ছবি প্রকাশ করে থাকে জাতীয়তাবাদীরা।’
প্রায় দুই দশক ধরে বেলুচ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে আসছে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে সরকারও অভিযান শুরু করেছে, যার ফলে হাজার হাজার জাতিগত বেলুচের মৃত্যু ঘটেছে ও নিখোঁজও হয়েছে।
আরো একটি সশস্ত্রগোষ্ঠী বেলুচ ইয়াকজেহতি কমিটি (বিওয়াইসি), যার নেতৃত্ব দেন ৩১ বছর বয়সী মাহরাং বালোচ। গোষ্ঠীটি এ বছরের জানুয়ারিতে ইসলামাবাদে দিনব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশ করেছিল। এ ছাড়া এই মাসের শুরুতে দেশটির দক্ষিণে গোয়াদর শহরেও অবস্থান সমাবেশ করেছিল, যা চলে টানা ১০দিনেরও বেশি।
সরকার এবং সামরিক সংস্থাগুলো অবশ্য বেলুচ ইয়াকজেহতি কমিটি (বিওয়াইসি)-কে পাকিস্তানের শত্রুদের দ্বারা অর্থায়ন করার জন্য অভিযুক্ত করে এবং এটিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রক্সি হিসেবে চিহ্নিত করে।
এ ঘটনায় আকবর যুক্তি দিয়েছেন, সরকারের এই পদ্ধতি একটি ভুল ছিল। তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় না বসে সরকার কেবল বেলুচ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সংকল্পকে শক্তিশালী করে তুলেছে। কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের আরো ন্যায্যতা প্রদান করেছে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং পাক ইনস্টিটিউট অফ পিস স্টাডিজ (পিআইপিএস) এর পরিচালক মুহম্মদ আমির রানা বলেছেন, ‘বিওয়াইসি-এর সাম্প্রতিক বিক্ষোভের পরে প্রদেশে উত্তেজনাও বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘বেলুচিস্তানে অস্থির পরিবেশের মধ্যেই এই ধরনের হামলা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করেছ। বিদ্রোহ এখন একটি জটিল পর্যায়ে চলে গেছে।’
রক্তে ভেজা ভূখণ্ড
২০২১ সালের আগস্টে আফগান তালেবানরা ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে পাকিস্তান ক্রমবর্ধমান হিংসাত্মক হামলা দেখেছে। বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং বেলুচিস্তানে, উভয়ই অঞ্চল আফগানিস্তানের সীমান্তে অবস্থিত।
পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (পিআইসিএসএস) অনুসারে, শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই ৬৫০ টিরও বেশি হামলা হয়েছে। যার ২৩ শতাংশ বেলুচিস্তানে ঘটেছে এবং ২৮৬জন মারা গেছে। কোয়েটা-ভিত্তিক বিশ্লেষক মুহাম্মদ আরিফের মতে, এই ক্রমাগত সহিংসতা প্রদেশটির ভৌগলিক সংমিশ্রিত।
তিনি বলেন, ‘বেলুচিস্তান বিক্ষিপ্ত জনসংখ্যাসহ একটি বিশাল এলাকা। যেটি সরকার এবং জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী উভয়ের জন্যই আশীর্বাদ আবার অসুবিধাও। সরকার সেখানে নিরাপত্তা দিতে পারছে না, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো কার্যকরভাবে বৃহৎ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দাবি করতে পারে না।’
আকবর যোগ করে বলেছেন, ‘সরকারের স্বার্থ এবং জননিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থতা স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আরো বেশি বিরক্তির কারণ হতে পারে।’
তিুন বলেছেন, ‘যেহেতু এই আক্রমণগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে এবং সরকার বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। ফলে স্থানীয় জনগণের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন বাড়তে পারে। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রচেষ্টা আরো জটিল হবে।’
তবে বেলুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষাবিদ আরিফ বলেছেন, সরকারকে বিচক্ষণভাবে এগিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমার মতে বেলুচিস্তানে এখন আগুন লেগেছে। নেতৃত্বকে অবশ্যই দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই বিচক্ষণ ও বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করতে হবে। এই রক্তপাত এখানকার মানুষকে গ্রাস করবে। তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ কারও উপকারে আসে না।’
সূত্র : আলজাজিরা