দ্যা নিউ ভিশন

নভেম্বর ২৫, ২০২৪ ১৪:৫০

ইউনিয়ন ব্যাংকের রহস্যময় হিসাবে ভোটের আগে অস্বাভাবিক নগদ লেনদেন

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেসরকারি ইউনিয়ন ব্যাংকের একটি হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। নির্বাচনের এক বছর আগে হিসাবটি খুলে জমা করা হয় নগদ টাকা। এরপর গত বছরের ডিসেম্বরে এসে শুরু হয় নগদ টাকা উত্তোলন। এভাবে এই হিসাব থেকে নির্বাচনের আগেই উত্তোলন করা হয় প্রায় ৭২ কোটি টাকা। ব্যাংকের বনানী শাখায় হিসাবটি খোলা হলেও নগদ টাকার বেশির ভাগ উত্তোলন করা হয়েছে প্রধান কার্যালয়ের নিচে থাকা গুলশান শাখা থেকে। ইউনিয়ন ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনায় এ তথ্য মিলেছে।

মোস্তাক ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এই হিসাব খোলা হয়েছিল। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২০ আগস্ট হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ব্যাংকটির অনলাইন তথ্যভান্ডার থেকে এই হিসাবে সব তথ্য গায়েব করে ফেলা হয়। যদিও হিসাব বন্ধ হলেও তথ্য মুছে ফেলার সুযোগ নেই। হিসাবের তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে, এমন হিসাবের সংখ্যা ইউনিয়ন ব্যাংকে আরও রয়েছে বলে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা।

নিশ্চয়ই এই বেনামি হিসাবটি নির্বাচনের কাজের জন্য খোলা হয়েছিল, সেই কাজে ব্যবহারও হয়েছে। ব্যাংকের এমডির নির্দেশ ছাড়া এমন হিসাব খোলা ও বন্ধ হতে পারে না। তদন্ত করে দেখতে হবে কারা এই হিসাব থেকে টাকা নিয়েছে।

মোস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক

রহস্যময় এই হিসাবের নামে ইউনিয়ন ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে ৫৫ কোটি টাকা ঋণও দেওয়া হয়েছিল। এই ঋণ এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে যে ঠিকানা ব্যবহার করে মোস্তাক ট্রেডার্সের হিসাব খোলা হয়, সেই ঠিকানায় এই প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাননি প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক।

ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন এমন অনেককে ও তাঁদের পক্ষের ব্যক্তিদের তাঁরা নির্বাচনের আগে এই হিসাব থেকে টাকা তুলতে দেখেছেন। ক্রিকেট থেকে চলচ্চিত্র তারকা, নবীন থেকে প্রবীণ প্রার্থীরাও ছিলেন এই তালিকায়। তাঁদের ধারণা, নির্বাচনের খরচ চালাতে এটা ছিল তৎকালীন সরকারের উপহার, যে খরচ দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। এ জন্য ইউনিয়ন ব্যাংকসহ তাঁর মালিকানায় থাকা আরও ব্যাংক থেকে এমন বেনামি ঋণ নেওয়া হয়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইউনিয়ন ব্যাংক ‘ব্যাংক খেকো’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ইউনিয়ন ব্যাংকের বনানী শাখায় হিসাবটি খোলা হয় ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর। একই দিন ১৭টি লেনদেনের মাধ্যমে নগদ ২৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা জমা করা হয়। এই ১৭টি লেনদেনের মধ্যে চারবার ২ কোটি টাকা করে জমা করা হয়। দেড় কোটি টাকা করে জমা করা হয় পাঁচবার। বাকি অর্থ জমা হয় অন্য অঙ্কের। এরপরের দিন ১৬ নভেম্বর সাতবারে জমা দেওয়া হয় নগদ ১০ কোটি টাকা।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এস আলম নিয়ন্ত্রিত আরও কয়েকটি ব্যাংকের পাশাপাশি ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এসব ব্যাংক এখন তারল্যসংকটে ভুগছে। গ্রাহকদের অনেকে তাঁদের আমানতের টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।

কথিত মোস্তাক ট্রেডার্সের হিসাবের ব্যাপারে ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর বক্তব্য জানতে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে একাধিকবার গেলেও তিনি সাক্ষাৎ দেননি। মুঠোফোনেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই এই বেনামি হিসাবটি নির্বাচনের কাজের জন্য খোলা হয়েছিল, সেই কাজে ব্যবহারও হয়েছে। ব্যাংক এমডির নির্দেশ ছাড়া এমন হিসাব খোলা ও বন্ধ হতে পারে না। তদন্ত করে দেখতে হবে কারা এই হিসাব থেকে টাকা নিয়েছে। আইনি পথে সেই টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এখনই সময় যারা এসব অপকর্মে জড়িত ছিল, তাদের আটকে ফেলা। তারা পালিয়ে গেলে তথ্য পাওয়া যাবে না, টাকা আদায়ে আইনি পথেও এগোনো যাবে না।’

জানা যায়, ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর একসঙ্গে দুটি চেক বই নেওয়ার জন্য চাহিদাপত্র দেয় গ্রাহক। পাশাপাশি ছয়বারে আবার ১০ কোটি টাকা জমা করা হয়। এরপর ২০ নভেম্বর ২০ কোটি টাকা ও ২১ নভেম্বর আরও ২০ কোটি টাকা জমা করা হয়। ৮ ডিসেম্বর ছয়বারে জমা হয় দেড় কোটি টাকা। এরপর ওই হিসাবে এক বছর কোনো লেনদেন হয়নি।

হিসাব খুলে লেনদেন যেভাবে

ইউনিয়ন ব্যাংকের বনানী শাখায় হিসাবটি খোলা হয় ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর। একই দিন ১৭টি লেনদেনের মাধ্যমে নগদ ২৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা জমা করা হয়। এই ১৭টি লেনদেনের মধ্যে চারবার ২ কোটি টাকা করে জমা করা হয়। দেড় কোটি টাকা করে জমা করা হয় পাঁচবার। বাকি অর্থ জমা হয় অন্য অঙ্কের। এরপরের দিন ১৬ নভেম্বর সাতবারে জমা দেওয়া হয় নগদ ১০ কোটি টাকা।

এই হিসাব খোলার সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, হিসাবধারীর পরিচয় যাচাই না করে সেই সময় এস আলমের ব্যক্তিগত সচিব আকিজ উদ্দিন ও ব্যাংকের এমডি এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর নির্দেশে হিসাবটি খোলা হয়েছিল। এই হিসাবই পরে নির্বাচনের সময় অর্থ লেনদেনের কাজে ব্যবহার করা হয়।

জানা যায়, ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর একসঙ্গে দুটি চেক বই নেওয়ার জন্য চাহিদাপত্র দেয় গ্রাহক। পাশাপাশি ছয়বারে আবার ১০ কোটি টাকা জমা করা হয়। এরপর ২০ নভেম্বর ২০ কোটি টাকা ও ২১ নভেম্বর আরও ২০ কোটি টাকা জমা করা হয়। ৮ ডিসেম্বর ছয়বারে জমা হয় দেড় কোটি টাকা। এরপর ওই হিসাবে এক বছর কোনো লেনদেন হয়নি।

এই হিসাব থেকে নগদ টাকা উত্তোলন শুরু হয় ২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর, চলে গত ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। ওই দিন বনানী শাখা থেকে এক চেকে উত্তোলন করা হয় ২ কোটি ৫১ লাখ টাকা ও ১৪ ডিসেম্বর গুলশান শাখা থেকে তোলা হয় ১ কোটি টাকা। এরপর সব টাকা তোলা হয় গুলশান শাখা থেকে। এর মধ্যে ২৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার তোলা হয় ৪১ কোটি টাকা। পৃথক পৃথক চেকে ১০ কোটি, ৬ কোটি ও পাঁচটি চেকে ৫ কোটি টাকা করে মোট ২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি তোলা হয় ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ৭ জানুয়ারি ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরপর ৯ জানুয়ারি পাঁচটি চেকের মাধ্যমে হিসাব থেকে পুরো ২৫ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়।

এরপর আর ওই হিসাবে লেনদেন বন্ধ ছিল। গত ১৫ আগস্ট পে–অর্ডারের মাধ্যমে হিসাবে থাকা ৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়। এরপর ২০ আগস্ট হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি তথ্যভান্ডার থেকে হিসাবটির তথ্য মুছে ফেলা হয়। ব্যাংকটির এমডির নির্দেশে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ এই তথ্য মুছে ফেলে বলে জানা যায়। জানা গেছে, নগদ টাকা তোলার ক্ষেত্রে নিয়ম থাকলেও গুলশান শাখায় টাকা উত্তোলনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি জমা দিতে হয়নি।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখার ভল্ট পরিদর্শনে গিয়ে ঘোষণার চেয়ে কম টাকা থাকার বিষয়টি দেখতে পেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কাগজপত্রে ওই শাখার ভল্টে যে পরিমাণ টাকা থাকার তথ্য ছিল, বাস্তবে তার চেয়ে প্রায় ১৯ কোটি টাকা কম পান কর্মকর্তারা। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তখন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ

ঝলমলে আইপিএল নিলামের অন্য রূপ: কালো তালিকা, রাতারাতি কোটিপতি আর ক্ষমতা প্রদর্শন

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ললিত মোদি। ভারতীয় ক্রিকেট