দ্যা নিউ ভিশন

নভেম্বর ২৫, ২০২৪ ০৭:৩৮

হাজারী–ঘনিষ্ঠ ৩০ জনের কাছে পিস্তল, রাইফেল ও শটগান ছিল

ছাত্র–জনতার ওপর গুলি ছুড়ছেন নিজাম হাজারীর অনুসারীরা। গত ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপাল এলাকায়

আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিনা ভোটে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের নামে একটি করে পিস্তল ও রাইফেলের লাইসেন্স নেন নিজাম উদ্দিন হাজারী। এর মধ্যে রাইফেলের লাইসেন্স নেন ২০১৬ সালে। পিস্তলের লাইসেন্স নেন ২০১৮ সালে। নিজাম হাজারী তাঁর স্ত্রী নূরজাহান বেগমের নামেও ২০২০ সালে একটি রাইফেলের লাইসেন্স করান। যদিও তিনি গৃহিণী।

নিজাম হাজারীর মতোই দুটি করে (পিস্তল ও শটগান) আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন ফেনীর আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগের আরও পাঁচজন নেতা। তাঁরা হলেন ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল আলিম, পরশুরাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন আহমেদ ওরফে সাজেল, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল, ফেনী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম ওরফে স্বপন মিয়াজী ও জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফর রহমান ওরফে খোকন হাজারী।

সব মিলিয়ে নিজাম হাজারী, তাঁর স্ত্রীসহ ফেনীর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ৩০ জন নেতা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স করেন। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় অস্ত্রের লাইসেন্স তাঁরা পেয়েছিলেন। এসব অস্ত্রসহ অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে গত জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার বিক্ষোভ দমনের কাজে। ফেনীর শহরের পাশে মহিপাল এলাকায় আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা গুলি ছুড়ছেন, এ রকম একটি ভিডিও ভাইরাল (ছড়িয়ে পড়া) হয়েছে সম্প্রতি। ঘটনাটি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার ঠিক এক দিন আগে গত ৪ আগস্টের। সেদিন গুলিতে মহিপালে ৯ জন নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে চারজন শিক্ষার্থী।

সব মিলিয়ে নিজাম হাজারী, তাঁর স্ত্রীসহ ফেনীর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ৩০ জন নেতা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স করেন। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় অস্ত্রের লাইসেন্স তাঁরা পেয়েছিলেন।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি করছেন তিন যুবক (দুজনের মাথায় ছিল হেলমেট)। তাঁদের হাতে একে-৪৭–এর মতো দেখতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।

ফুটেজে যে তিনজনকে দেখা গেছে, তাঁদের একজন ফেনী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি জিয়াউদ্দিন বাবলু, আরেকজন ফেনী সদরের কাজীরবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফ। বলে জানা গেছে। বিষয়টি পুলিশও নিশ্চিত করেছে। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সেদিন মহিপাল এলাকায় অন্তত ৩৩ জনের হাতে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তাঁদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁরা সবাই ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম হাজারীর অনুসারী।

মহিপাল এলাকায় সেদিন যেসব অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল, তার কয়েকটি দেখতে একে-৪৭–এর মতো। অবশ্য পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটের একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, দেখতে একে-৪৭–এর মতো হলেও অস্ত্রগুলো তুরস্কের তৈরি অত্যাধুনিক শটগান।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি করছেন তিন যুবক (দুজনের মাথায় ছিল হেলমেট)। তাঁদের হাতে একে-৪৭–এর মতো দেখতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।

নিজাম হাজারীর সহযোগীরা বিভিন্ন অপকর্ম করতে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন ও ব্যবহার করত। তার একটি উদাহরণ হলো, ২০২১ সালের জুলাই মাসে ফেনী শহরের সাহেববাড়ি এলাকায় ট্রাকভর্তি গরু লুট করতে গিয়ে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম। তিনি ফেনী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর। কালাম একসময় যুবদলের রাজনীতি করতেন। নিজাম হাজারীর সংসদ সদস্য হওয়ার পর তাঁর হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিনি। পর তাঁকে ফেনী পৌরসভার একটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়।

লাইসেন্স করা অস্ত্রের পাশাপাশি নিজাম হাজারীর অনুসারীদের কাছে প্রচুর অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশের একাধিক সূত্র। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় নিজাম হাজারীর অনুসারীদের ফেনী শহরে অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা গেছে। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো ওই সব ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নীরব থাকত। তবে ২০১৫ সালের ৬ জুন র‍্যাবের হাতে নিজাম হাজারীর ২৬ জন সহযোগী দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রসহ একবার ধরা পড়েছিলেন। পরে তাঁদের সবাই বিভিন্ন সময়ে জামিনে বেরিয়ে যান।

ফেনী জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রধারীদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করে হত্যার ঘটনায় কয়েকটি মামলা হয়েছে। এসব মামলার তদন্ত চলছে। আর যাঁরা গুলি করেছেন, তাঁদের চিহ্নিত করার কাজটি চলমান আছে।

ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমনে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার

ফেনী আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের দরপত্র নিয়ন্ত্রণকারীদের অন্যতম ছিলেন নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠ শুসেন চন্দ্র শীল। তিনি ফেনী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান। তাঁর সঙ্গে অস্ত্রধারী ‘ক্যাডার’ হিসেবে কাজ করতেন ফেনী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি জিয়াউদ্দিন বাবলু। এ ছাড়া নিজাম হাজারী ও শুসেনের হয়ে বিভিন্ন এলাকার মানুষকে ভয় দেখিয়ে জমি দখল ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন এই বাবলু। তিনি প্রকাশ্যেই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র বলছে, গত ৪ আগস্ট মহিপাল এলাকায় একে-৪৭–এর মতো দেখতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলি ছুড়েছেন বাবলু। সেদিন ঘটনাস্থলে ছিলেন শুসেন চন্দ্র শীল, নজরুল ইসলাম ওরফে স্বপন মিয়াজী (ফেনী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র) ও হারুন মজুমদার (ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান)।

অস্ত্রধারীদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করে হত্যার ঘটনায় কয়েকটি মামলা হয়েছে। এসব মামলার তদন্ত চলছে। আর যাঁরা গুলি করেছেন, তাঁদের চিহ্নিত করার কাজটি চলমান আছে।

ফেনী জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান

এ ছাড়া সেদিন মহিপাল এলাকায় আরও ছিলেন ফেনী সদর উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান করিম উল্লাহ ওরফে রেন্সু করিম, জেলা যুবলীগের সহসভাপতি ও শর্শদী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জানে আলম ভূঁইয়া এবং জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফর রহমান ওরফে খোকন হাজারী। এই তিনজনকেও সেদিন আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে। ৪ আগস্টের ভিডিও ফুটেজে তাঁদের দেখা গেছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এ ছাড়া ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর হামলার সময় ফেনী সদর উপজেলার কাজীরবাগ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বুলবুল আহমেদের হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। ঘটনাস্থলে আরও ছিলেন ফেনী সদরের পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে লিটন, ছাগলনাইয়ার পাঠাননগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল হায়দার চৌধুরী ওরফে জুয়েল এবং ছাগলনাইয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী ওরফে সোহেল।

ফেনী জেলা প্রশাসন থেকে সংগ্রহ করা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফেনী জেলায় ব্যক্তিপর্যায়ে ১০৩টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ৩০ জন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, ১৯৯৬ সালের জুনে যখন আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছিল, তখন ফেনীর তৎকালীন সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারীর অনুসারী ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছিলেন।

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ

ঝলমলে আইপিএল নিলামের অন্য রূপ: কালো তালিকা, রাতারাতি কোটিপতি আর ক্ষমতা প্রদর্শন

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ললিত মোদি। ভারতীয় ক্রিকেট